লালমনিরহাট প্রতিনিধি:: তিস্তা নদীর চরে দেশের বৃহত্তম স্ট্রবেরি প্রকল্প গড়ে উঠেছে, যা স্থানীয় কৃষকদের জন্য সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই প্রকল্প একদিকে যেমন স্ট্রবেরি চাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে, তেমনই অন্যদিকে কৃষকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর গ্রামের স্ট্রবেরি চাষি হাবিবুর রহমান (৪৫) এই প্রকল্পের একজন সফল উদাহরণ। তিনি মাত্র এক বিঘা জমিতে ৪ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে স্ট্রবেরি চাষ শুরু করেছিলেন এবং ইতোমধ্যেই ৫ লক্ষ টাকার স্ট্রবেরি বিক্রি করেছেন। তার আশা, তিনি আরও দুই লক্ষ টাকা বা তার বেশি টাকার স্ট্রবেরি বিক্রি করতে পারবেন। হাবিবুর রহমান গত তিন বছর ধরে স্ট্রবেরি চাষ করছেন এবং গত বছর নিজেই স্ট্রবেরি চারা উৎপাদন করেছেন। তার এই অভিজ্ঞতা অন্যদেরও স্ট্রবেরি চাষে উৎসাহিত করছে।
অন্যদিকে, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বজরা ইউনিয়নের বজরা গ্রামে তিস্তা নদীর চরে দেশের বৃহত্তম স্ট্রবেরি প্রকল্পটি স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় ১২ একর জমিতে সাড়ে তিন লক্ষ স্ট্রবেরি চারা রোপণ করা হয়েছে। এই বিশাল প্রকল্পে আব্দুর রাজ্জাক এবং হারুনুর রশিদ নামে দুই উদ্যোক্তা এক কোটি ৪৬ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এই প্রকল্পটি তিস্তার চরাঞ্চলে স্ট্রবেরি চাষের এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
তবে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কুড়িগ্রামে আটটি প্লটে ১৫ একর এবং লালমনিরহাটে ছয়টি প্লটে ৪ একর জমিতে স্ট্রবেরি চাষ করা হলেও, ফলন সব ক্ষেত্রে একই রকম হচ্ছে না। ভালো ফলন পেতে হলে উন্নত মানের চারা নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক চারা নির্বাচনের মাধ্যমে স্ট্রবেরি চাষিরা তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে এবং লাভজনক হতে সক্ষম হবেন।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার নাজিমখান গ্রামের আরেক কৃষক শরিফুল ইসলাম (৫০) এক একর জমিতে স্ট্রবেরি চাষ করে ভালো ফলন পাচ্ছেন এবং লাভবান হচ্ছেন বলে জানান। তিনি ১১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা খরচ করে ইতোমধ্যেই ১৬ লক্ষ টাকার স্ট্রবেরি বিক্রি করেছেন এবং আরও ৩-৪ লক্ষ টাকার বিক্রির আশা করছেন। গত চার বছর ধরে স্ট্রবেরি চাষ করে তিনি সফলতার মুখ দেখেছেন।
তবে, তিস্তা নদীর চরে দেশের বৃহত্তম স্ট্রবেরি প্রকল্প প্রস্তুতকারী দুই উদ্যোক্তা আব্দুর রাজ্জাক এবং হারুনুর রশিদ আশানুরূপ ফলন না পাওয়ায় কিছুটা হতাশ। তারা জানান, বিভিন্ন জায়গা থেকে ৬টি জাতের সাড়ে তিন লক্ষ স্ট্রবেরি চারা সংগ্রহ করতে তাদের ৪২ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। প্রকল্পে চারজন কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে, যাদের মাসিক বেতন ১৫ হাজার টাকা। চর এলাকায় স্ট্রবেরি চাষের জন্য পর্যাপ্ত সার, কীটনাশক এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তাদের সংগ্রহ করা স্ট্রবেরি চারা ভালো মানের ছিল না। প্রতি একর জমিতে ৮-১৯ টন ফলনের আশা থাকলেও বর্তমানে মাত্র এক টন ফলন পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি কেজি স্ট্রবেরি ৪৫০-৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তিনি জানান, এই প্রকল্পে তাদের প্রায় এক কোটি টাকা লোকসান হতে পারে।
অপর উদ্যোক্তা হারুনুর রশিদ জানান, স্ট্রবেরি খেতের যত্নে তারা কোনো ত্রুটি রাখেননি এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। প্রত্যাশিত ফলন না পাওয়ায় তারা হতাশ হলেও আশা ছাড়েননি। তিনি বলেন, “ভবিষ্যতেও আমরা তিস্তা চরে একটি স্ট্রবেরি প্রকল্প করব। আগামী বছর আমরা নিজেরাই চারা প্রস্তুত করব।”
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, তিস্তা চরে ১২ একর জমিতে দুই উদ্যোক্তার এই স্ট্রবেরি প্রকল্পটি দেশের বৃহত্তম। চারা নির্বাচনে ভুলের কারণে তারা প্রত্যাশিত ফলন পাননি। তিনি জানান, প্রতি একর জমিতে স্ট্রবেরি চাষ করতে ১২-১৩ লক্ষ টাকা খরচ হয়। তিনি পরামর্শ দেন, উদ্যোক্তারা যদি নিজেরাই চারা উৎপাদন করেন এবং আগামী বছর প্রকল্প শুরু করেন, তাহলে তারা লাভবান হতে পারবেন।