তাহমিনা আক্তার,ঢাকা:: মৌসুমি ফ্লু, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ডেঙ্গুতে কাবু রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ। চার ধরনের জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভিড় বাড়ছে রোগীদের। তাদের সবারই জ্বরের সঙ্গে কমবেশি সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গ রয়েছে। জ্বর যে কারণেই আসুক, রোগী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে বড় আশঙ্কা হয়ে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু হলো কিনা।
হাসপাতালগুলোতে এসব জটিলতা নিয়ে আসলে চিকিৎসকরাও দিচ্ছেন ডেঙ্গু পরীক্ষা। দেখা গেছে, পরীক্ষায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু শনাক্ত হলেও অধিকাংশই ভুগছেন মৌসুমি জ¦রে। সঙ্গে আছে কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রকোপও। স্থিতিশীল থাকলেও এখনো নির্মূল হয়নি ভাইরাসটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামান্য অবহেলাতেই ঘটতে পারে বিপদ। তাই যে কোনো জ¦রই দেখা যাক না কেন, নিকটস্থ হাসপাতালে যাওয়ার তাগিদ তাদের। যাদের কো-মরবিডিটি (একসঙ্গে একাধিক জটিল রোগ) রয়েছে, তাদের মাস্ক ব্যবহারের প্রতি জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
শাফিন বিন তারেক ও তাহিয়া তুবা নূর। চার দিন ধরে জ্বর ও বমিসহ নানা জটিলতায় ভুগছে ছোট্ট দুই শিশু। রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দা ওবায়দুল্লাহ তারেকের সন্তান তারা। ডেঙ্গু সন্দেহে তিন তিনবার পরীক্ষা করেছেন, তবে প্রত্যেকবারই ফল নেগেটিভ এসেছে।
ওবায়দুল্লাহ তারেক বলেন, ‘তীব্র জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা তাদের। বমিও করছে। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে নিচ্ছি, চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়াচ্ছি; কিন্তু কিছুতেই জ্বর কমছে না। ভেবেছি ডেঙ্গু হয়েছে, তাই তিন দফা পরীক্ষা করিয়েছি। কিন্তু ডেঙ্গুর উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। তবে শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল হয়ে গেছে।’
গণমাধ্যমকর্মী হাসান শান্তনুর মেয়ে পল্লবী সোনম। ১১ মাসের এই শিশু পাঁচদিন ধরে তীব্র জ্বরে ভুগছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, সোনম ‘এন্টরিক ফিভারে’ ভুগছে। বর্তমানে রাজধানীর আইসিডিডিআরবিতে চিকিৎসাধীন শিশুটি।
শুধু শিশুরা নয়, জ্বর ও শরীর ব্যথাসহ নানা জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্কদের। তিন দিন জ্বরে ভুগে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন রাজধানীর বাড্ডার বাসিন্দা আলতাফ মাহমুদ (২৭)। গত ২৬ আগস্ট জ্বর শুরু হলে ডেঙ্গু সন্দেহে পরীক্ষা করান। তবে পরীক্ষায় ফল নেগেটিভ আসে।
আলতাফের স্ত্রী ফাহিমা বেগম জানান, ‘হঠাৎ করেই জ্বর। পরিবারের তিন সদস্যের দুজনই এখন জ্বরে ভুগছে। ডেঙ্গু সন্দেহ হলে পরীক্ষা করাই। ধরা না পড়লেও শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ হতে থাকে। তাই এখানে এনে দ্বিতীয় দফা পরীক্ষা করালে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। অবস্থার তেমন উন্নতি নেই। স্যালাইন চলছে।’
রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি একাধিক হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালে আসা অধিকাংশ রোগী জ্বর, মাথাব্যথা, গলাব্যথাসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগী। তবে পরীক্ষায় অনেকের ডেঙ্গু শনাক্ত হলেও অধিকাংশই মৌসুমি জ্বরে আক্রান্ত বলে জানান চিকিৎসকরা। তিন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, নমুনা পরীক্ষায় ১৮ থেকে ২০ শতাংশ রোগীর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘জ্বর আসলে কোনো রোগ না, এটা রোগের লক্ষণমাত্র। শরীরে কোনো রোগজীবাণুর সংক্রমণে সাধারণত জ্বর হয়ে থাকে। এই সিজনে ডেঙ্গু, করোনা, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও টাইফয়েডের প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের ডেঙ্গু বেশি হচ্ছে কারণ প্রথমত তারা মশার কামড়ের ব্যাপারে বড়দের মতো সচেতন থাকে না। যেসব গর্ভবতী মায়ের ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়, তাদের বাচ্চাদের শরীরে মায়ের কাছ থেকে অ্যান্টিবডি যায় এবং পরিবর্তী সময় বাচ্চা ভিন্ন সেরোটাইপ দিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে খুব দ্রুত শক সিন্ড্রোম বা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হতে পারে। তা ছাড়া বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, ডেঙ্গু হলে পর্যাপ্ত সুষম খাবার এবং তরল খায় না বলে জটিলতা বেড়ে যায়।’
কোভিডের পর ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় ডেডিকেটেড করা হয়েছে মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতাল। এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গতকাল সোমবার পর্যন্ত ২৭১ জন রোগী চিকিৎসাধীন ছিল হাসপাতালটিতে। প্রতিদিন বহিঃবিভাগ ও ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৪০০ জনের ডেঙ্গু পরীক্ষা হচ্ছে। বর্তমানে থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টির আগে হাসপাতালটিতে রোগীদের ডেঙ্গু শনাক্তের হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হলেও বর্তমানে তা ৩০ শতাংশে উঠেছে। তবে বর্তমানে অন্যান্য পরীক্ষা কমেছে।