মনজু হোসেন,স্টাফ রিপোর্টার:: গত বছর আশ্বিন মাস থেকে চলতি বছর বছরের শ্রাবণ মাস পর্যন্ত পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের যত মেয়ের বিয়ে হয়েছে তাদের অধিকাংশই ফিরেছে বাপের বাড়িতে। আনুষ্ঠানিক ও লৌকিক লোকাচার রীতি মেনেই বেশ ঘটা করেই তারা আসছেন বাপের বাড়িতে।
যে কারণে নববধূরা বিয়ের পর প্রথম ভাদ্রমাস আসার আগেই শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে আসেন:
স্বামীর মঙ্গল কামনার লক্ষ্যে ভাদ্র মাসের প্রথম তিনদিন তারা স্বামীর মুখ দর্শন করা থেকে বিরত থাকে। স্থানীয় ভাবে লোকাচার রয়েছে বিয়ের প্রথম বছরের ভাদ্র মাসের ১ থেকে ৩ তারিখ স্বামীর মুখ দর্শন করলে স্বামীর অমঙ্গল হয় এবং চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
শ্রাবণের শেষ সপ্তাহে বাবা বাড়ির লোকজন পায়েস, নানা স্বাদের পিঠা-পুলি, মিষ্টান্ন ও ফলমূল নিয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে মেয়েকে আনতে যায়। মেয়ের বাড়ি থেকে পাঠানো মজাদার সেই খাদ্যসামগ্রী আশপাশের প্রতিবেশিদের বাড়িতে বিতরণও করেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার মীরগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহাজুল ইসলাম, সহকারী শিক্ষক আতাউর ররহমান ও সদর উপজেলার ডাবরভাংগা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক সময় সংবাদকে বলেন, উৎসবের রীতি অনুযায়ী গত এক বছরে যত মেয়ের বিয়ে হয়েছে তারা বিয়ের প্রথম বছরের প্রথম ভাদ্রমাসের এক থেকে তিন তারিখ পর্যন্ত টানা তিনদিন স্বামীর মঙ্গল কামনায় স্বামীর মুখ দর্শন করবে না।
তারাও তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে বউয়ের বাড়ির লোকজনকে সমাদর করার।
সারাদিনই হৈচৈ আর উৎসবে মেতে উঠে নববধূর শ্বশুরবাড়ি। ভাদ্র মাসে অনুষ্ঠিত নববধূকে বাবার বাড়িতে আনার এ রেওয়াজটি স্থানীয়দের কাছে ভাদর কাটানি উৎসব নামে পরিচিত।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে ‘ভাদর কাটানি’র কোন ব্যাখ্যা না থাকলেও এ অঞ্চলের আদি প্রথা অনুযায়ী এ উৎসবটি যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে। ‘নববিবাহিতা বধূ বাবার বাড়িতে মেহমান হিসেবে ঘটা করেই বাড়িতে ফিরবে এটা অনেক আনন্দের একটি বিষয়।
যারা মনে প্রাণে বাঙালী যারা বাঙালীর রীতিনীতি ও প্রথা মেনে চলেন বা মানার চেষ্টা করেন তাদের নিয়মের ভেতরেই রয়েছে ভাদর কাটানির এই প্রথা।
স্থানীয় বয়ঃজ্যেষ্ঠদের সাথে কথা বলে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে এবং ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিনাজপুর মালদহ এবং মুর্শিদাবাদের কোন কোন অংশে এই প্রথা এখনও চালু আছে।
এছাড়া জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি জেলার কোন কোন অংশেও এই প্রথা বাঙালী সমাজে চালু রয়েছে বলে জানা যায়। আধুনিক যুগে ভাদর কাটানির পক্ষে নিরপেক্ষ তর্ক-যুক্তি নাই। তবুও ভাদর কাটানি উৎসব থেমে নেই।
তবে জেলার গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, বিবাহিত জীবনের প্রথম ভাদ্র মাসের এক থেকে তিন তারিখ পর্যন্ত স্বামীর মুখ দেখলে পরিবারে অমঙ্গল হবে। তাছাড়া সাধারণত ভাদ্র মাসে এ জেলায় বিয়ের কোন আয়োজনও চোখে পড়ে না ।
সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনি্রযনের ঘাটিয়ারপাড়া গ্রামের নববধূ শিলা আকতার বলেন, বিবাহিত জীবনের প্রথম ভাদ্রমাসে ভাদর কাটানি উপলক্ষে বাবার বাড়িতে এসে অনেক ভালো লাগছে। যদিও স্বামীর সাথে এই কদিন দেখা হবে না; তবে ফোনে প্রতিদিনই একাধিকবার যোগাযোগ হয়। আমরা উভয়ই উভয়ের খোঁজ খবর নিই।
প্রচলিত এ প্রথাটি যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলে হিন্দু- মুসলিমদের মধ্যে চালু রয়েছে। প্রথা অনুযায়ী, কনেপক্ষে শ্রাবণ মাসের দু’একদিন বাকি থাকতেই বরপক্ষের বাড়িতে সাধ্যমতো বিভিন্ন রকমের ফল, মিষ্টি, পায়েসসহ নানারকম পিঠা-পুলি নিয়ে যায়। বরপক্ষও সাধ্যমতো তাদের আপ্যায়ন করে। বাড়িতে কনে পক্ষের লোকজন আসায় চারদিকে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে।
ভাদর কাটানি মুসলিম সম্প্রদায়ের কোন ধর্মীয় বিষয় না হলেও এ অঞ্চলে আবহমান কাল থেকে প্রথাটি চলে আসছে। এক সময় সম্ভ্রান্ত হিন্দু সম্প্রদায় এ উৎসবকে জাকজঁমকভাবে পালন করত। তাদের এ রেওয়াজ ত্রুমান্বয়ে এ অঞ্চলের মানুষকে প্রভাবিত করে। এক পর্যায়ে উৎসবটি এ অঞ্চলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
মানিকপীর বেংহারী ফাজিল মাদরাসার সহকারী অধ্যাপক সেলীনা আকতার সময় সংবাদকে বলেন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভাদর কাটানি নামে কোন উৎসব না থাকলেও নববধূরা একে কেন্দ্র করে বাবার বাড়িতে কিছুদিন থাকার সুযোগ পায়; আত্মীয় স্বজনদের দেখা সাক্ষাৎ হয় এটা অনেক আনন্দের।