কনকনে শীত। ঘন কুয়াশায় দুই হাত আগে কিছু দেখা যায় না। টিনের ঢেউয়ের সারিগুলো থেকে যেভাবে টপটপ করে পানি ঝরছে মনে হচ্ছে যেন বৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যা নামতেই খেঁকশিয়ালগুলো জোটবেঁধে হুক্কাহুয়া শুরু করে দেয়।
আঁধার নেমে আসতে না আসতে দু লোকমা মুখে পুরে জামিল সেই যে লেপের নীচে ঢোকে সূর্য ওঠার আগে আর তার বের হতে মন চায় না। মাদরাসা খোলা থাকলে নামায-কালাম, পড়া-শোনা সবই ঠিকমত হত। কিন্তু শীতের এ বিরতিতে ফজরের সময় লেপের মুড়িটা সরানোই তার জন্য বড় কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ওযুর কথা মনে হলেই যেন লোমগুলো কাঁটা দিয়ে ওঠে।
মোল্লাবাড়ির মসজিদ প্রাঙ্গণে বাৎসরিক ওয়াজ মাহফিল। বড় বড় আলেম-উলামা ও পীর-বুযুর্গ তাশরীফ রাখেন সেখানে। বহু দূর দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে সেই মাহফিলে ওয়াজ শুনতে। মাহফিলকে ঘিরে এলাকাবাসীর মাঝে একটা সাজসাজ রব পড়ে যায়।
জামিল এবার দাদার সঙ্গে মাহফিলে যাবে। চাদর-মোজা, সোয়েটার-মাফলার গায়ে জড়িয়ে দাদা-নাতি রওনা দেয় মাহফিলের উদ্দেশে। পথে যোগ হয়েছেন পাড়ার আরো দাদারা। গল্পে গল্পে তারা চলেছেন ওয়াজ মাহফিলের দিকে।
দাদার পানের বাটাটা জামিলের হাতে। মাহফিলের কাছে আসতেই দেখা যায় আচার নিমকি, বাদাম-বুট, ঝালমুড়ি-চানাচুরসহ হরেক রকমের পসরা। দাদা সেখান থেকে জামিলকে কিনে দিলেন এক প্যাকেট চিনা বাদাম ও এক প্যাকেট চনাবুট। বাদাম-বুট হাতে পেয়ে জামিল যে কী খুশি, তা আর কে দেখে!
জামিল প্যান্ডেলে গিয়ে দেখে অনেক বড় একজন হুযুর ওয়াজ করছেন। কী নূরানী তার চেহারা! কত সুমধুর তার তিলাওয়াত! দাদা জামিলকে নিয়ে একপাশে বসে যান ওয়াজ শোনার জন্য।
জামিল ওয়াজ শুনছে। হুযুর কুরআনের আয়াত শোনাচ্ছেন। নবীজীর হাদীস শোনাচ্ছেন। তরজমা-তাফসীর করছেন। জান্নাতের বিবরণ শোনাচ্ছেন। জাহান্নামের ভয়াবহতার কথা বলছেন। নামায পড়তে বলছেন। আল্লাহ্র হুকুম মানতে বলছেন। সবার সাথে ভালো ব্যবহার করতে বলছেন। পর্দা করতে বলছেন। হারাম ছাড়তে বলছেন। জামিল হুযুরের অনেক কথা বুঝছে, অনেক কথা বুঝতে পারছে না। কিন্তু সে দেখছে, হুযুরের কথা শুনে দাদার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে।
মাহফিল শেষে মুনাজাত হল। হুযুর কাঁদলেন। সবাই কাঁদল। জামিলও কাঁদল। মুনাজাতে আল্লাহ্র নিকট হুযুর ওয়াদা করলেন- ইয়া আল্লাহ! আমরা এখন থেকে আপনার হুকুম মানব। পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ব। আপনার নাফরমানি করব না। আমরা তওবা করছি, আপনি কবুল করুন। আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
মুনাজাতের পর হুযুরের সাথে দাদা মুসাফাহা করলেন। জামিলের জন্য দুআ চাইলেন। হুযুর দুআ করে দিলেন- আল্লাহ কবুল করুন, বড় আলেম বানান।
মাহফিল শেষে ঘরে ফিরতে ফিরতে একটু রাত হয়ে গেছে। দাদা বলে দিলেন, ফজরের সময় ঠিকমত উঠতে হবে কিন্তু!
ফজরের আযান হচ্ছে। অন্যান্য দিনের মত দাদা ডাক দিলেন- জামিল! নামাযের সময় হয়েছে।
জামিল লেপ মুড়িতে। সে শুনতে পেল দাদার কণ্ঠ। কিন্তু এই শীতে লেপ থেকে মুখ বের করে কীভাবে! মনে হল তার রাতের ওয়াজের কথা। হুযুর বলেছিলেন, বাবারা! নামাযে গড়িমসি করবেন না। নামাযে অবহেলা করা খুবই খারাপ কথা। এতে আল্লাহ তাআলা নারায হন।
ঠিকমত নামায আদায় করবেন। নামাযী ব্যক্তির ব্যাপারে বড় খোশখবরী রয়েছে। আর বিশেষ করে ফজরের নামাযের প্রতি যত্নবান হবেন। নবীজী বলেছেন-
مَنْ صَلّى البَرْدَيْنِ دَخَلَ الجَنّة.
যে ব্যক্তি বারদাইন (দুই ঠাণ্ডার সময়ের নামায অর্থাৎ এশা ও ফজরের নামায) আদায় করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭৪
কিন্তু এত শীতের মধ্যে সে নামাযের জন্য ওযু করবে কীভাবে? ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ওযু করা কি চাট্টিখানি কথা! কিন্তু না, তাকে নামাযে যেতেই হবে। হুযুর না বলেছিলেন- ওযুর পানির সাথে বান্দার সগীরা গুনাহগুলো ধুয়ে মুছে পাক ছাফ হয়ে যায়। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৪) তাহলে ওযু করতে ভয় কীসের!
বিশেষ করে শীতকালে এবং অন্য যেকোনো কষ্টকর মুহূর্তে ওযু-নামাযের প্রতি যত্নবান হওয়ার জন্য নাকি রয়েছে অনেক ফযীলত, অনেক বড় পুরস্কার। হুযুর বলেছিলেন, নবীজী বলেছেন-
أَلَا أَدُلّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللهُ بِهِ الْخَطَايَا، وَيَرْفَعُ بِهِ الدّرَجَاتِ؟ قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ…
আমি কি তোমাদেরকে এমন বিষয়ের সংবাদ দিব না, যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেবেন (অর্থাৎ তোমাদেরকে মাফ করে দেবেন) এবং (আল্লাহর নিকট) তোমাদের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি করে দেবেন? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, অবশ্যই, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নবীজী বললেন, (শীত বা অন্য যে কোনো) কষ্টকর মুহূর্তে ভালোভাবে ওযু করা।… -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫১
কিন্তু শয়তানের শয়তানী হল, সে আমাদেরকে নামায থেকে দূরে রাখতে ষড়যন্ত্র করে। বিশেষ করে ফজরের সময় সে আরো ঘুম পাড়াতে থাকে। এজন্য শয়তানকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।
তার আরো মনে পড়ল মুনাজাতে আল্লাহ তাআলার দরবারে ওয়াদা করার কথা। এসব মনে পড়তেই এক ঝটকায় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল জামিল। দাদার সাথে ফজরের নামায পড়তে গেল।