আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক।। মিয়ানমারে ‘গণতান্ত্রিক’ একটি সরকারকে সরিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছে সামরিক জান্তা। বিশ্বজুড়ে অনেকেই এখন এ নিয়ে হাপিত্যেশ করতে শুরু করেছেন। পাঠক, লক্ষ করে থাকবেন ‘গণতন্ত্র’ শব্দটা আমি ঊর্ধ্ব কমার মধ্যে রেখেছি। কেন, তার ব্যাখ্যা মনে হয় দেওয়া প্রয়োজন। নির্ধারিত বিরতিতে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থী বা দলের পক্ষে ভোট দেওয়ার মধ্যেই শুধু গণতন্ত্র সীমিত থাকে না, থাকাটা যুক্তিযুক্তও নয়। গণতন্ত্রের অনেক শর্তের একটি হচ্ছে ভোট। আমাদের পছন্দের সেই সরকার জনতার ভোটে ক্ষমতাসীন হয়ে গণতন্ত্রের অন্যান্য শর্ত কতটা পূরণ করল কিংবা না করল, তার ওপরই মূলত নির্ভর করে সরকার কতটা গণতান্ত্রিক। অর্থাৎ পরিচয়ের দিক থেকে আমি আসলেই গণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পেরেছি কি না, সেটাই বিবেচ্য।
অভ্যুত্থানে মিয়ানমারে সেনা শাসন কায়েম হয়েছে ঠিকই কিন্তু গণতন্ত্র গেল বলে যাঁরা হা-হুতাশ করছেন, তঁারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন অং সান সু চির সরকার ঠিক কতটা গণতান্ত্রিক ছিল? ভূমিধস জয় নিয়ে সেই সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার বিষয়টিকে নিশ্চয়ই অবজ্ঞা করা যায় না। তবে শুধু এটুকুই, এর বাইরে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর দলের আর কোনো অর্জন আপাতত আমার নজরে আসছে না। ‘গণতান্ত্রিক’ সেই সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানো এবং তাদের বিশাল এক অংশকে ভয়ভীতি দেখিয়ে দেশছাড়া করা। কোনো অবস্থাতেই এটা গণতান্ত্রিক আচরণ হতে পারে না।
আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় হিটলারও জনতার ভোটেই নির্বাচিত হয়েছিলেন। হিটলারের সেই জয় ভূমিধস বিজয় মোটেও ছিল না, ফলে কিছুটা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে তাঁকে ক্ষমতা হস্তগত করতে হয়েছিল। ক্ষমতায় বসে যাওয়ার পর যেভাবে পেরেছেন, গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে গেছেন। সেই প্রক্রিয়ায় হিটলারের প্রথম লক্ষ্য ছিল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। কেননা, সংকটকালে সব রকম সমস্যার দায়দায়িত্ব সংখ্যালঘুদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের বাহবা পাওয়া হচ্ছে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের সহজ পথ। তৃতীয় রাইখের শুরুতে হিটলারও ইহুদিদের বিরুদ্ধে বিশাল জনগোষ্ঠীকে সহজেই লেলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। মিয়ানমারের ‘গণতান্ত্রিক’ নেত্রীকেও আমরা কিন্তু সেই একই পুরোনো খেলা খেলতে দেখতে পাই।
অনেকেই বলবেন, সমস্যা তো অং সান সু চি কিংবা তাঁর ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি তৈরি করেনি। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর ধর্ষণ-নিপীড়নও তারা চালায়নি, চালিয়েছে সামরিক বাহিনী। হ্যাঁ, এই কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আমরা যদি কিছুটা পেছনে তাকাই তাহলে কী দেখি? রোহিঙ্গা সংকট আগেও তৈরি হয়েছিল। সংকটের সমাধানের কিছু পথও তখন খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। তবে এবারের সংকট তৈরি হয়েছে কিন্তু ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার ক্ষমতাসীন থাকার সময় এবং সেই সরকারের নেতৃত্বে থাকা সু চি যেভাবে পেরেছেন, অসহায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে অবমাননাকর উক্তি করতেও তিনি পিছপা হননি, হত্যা-ধর্ষণের পক্ষে সাফাই গাওয়া থেকেও বিরত থাকেননি। আর এর মধ্য দিয়ে সংখ্যাগুরু বর্মিদের হাততালি তিনি পেয়েছেন। সারা বিশ্ব যখন তাঁর সেই অবস্থানকে ধিক্কার দিয়েছে, সে অবস্থায়ও হেগে নিজেদের সেই ঘৃণিত কর্মকাণ্ডের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। ফলে কারও পক্ষেই তাঁকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা সম্ভব হয়নি। সারা বিশ্বের মানুষের যত ভালোবাসা আগে তিনি পেয়েছিলেন, এক লহমায় তার সবটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
এহেন গণতান্ত্রিক নেতা যখন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দেনদরবারে হেরে গিয়ে নিজেকে আবার গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করেন, তখন তা অনেকটাই হাস্যকর শোনায় এবং তাঁর জন্য করুণা হয়। হাস্যকর এ জন্য যে সামরিক বাহিনী যে আচরণ এখন তাঁর সঙ্গে করছে, এর চেয়ে অনেক বেশি নিষ্ঠুর আচরণ তিনি নিজের দেশের সংখ্যালঘু একটি জাতিগোষ্ঠীর ওপর করেছেন। আর করুণা এ জন্য যে পাকে পড়ে তিনি আর তাঁর অনুসারীরা এখন সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছেন। ফলে গণতন্ত্র আসলে এখানে মুখ্য নয়।
১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে এদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে চলেছি আমরা। এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি আমাদের কোন আলোকে দেখা দরকার? আমার মনে হয়, মিয়ানমারে কোন সরকার ক্ষমতায় সেটা আমাদের বিবেচনার বিষয় হওয়া উচিত নয়। আমাদের উচিত আমাদের স্বার্থ নিশ্চিত করার চেষ্টা করা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
বছরের পর বছর ধরে শরণার্থীর বোঝা বহন করে যাওয়া বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের একটি দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। স্থানীয় এবং কিছুটা বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলার বিষয়টিও রয়েছে। ফলে যথেষ্ট প্রজ্ঞার সঙ্গে বিষয়টিকে আমাদের দেখতে হবে; আন্তর্জাতিক বিভিন্ন এনজিও, ব্যবসায়ী এবং পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টিতে নয়। অর্থাৎ সু চি এবং তাঁর দলের মূল্যায়ন আমাদের করতে হবে ধর্ম পরিচয়ে নয়, কর্ম পরিচয়ে। এরা গণতন্ত্রের লেবাস পরে থাকলেও রোহিঙ্গা সমস্যা দেখিয়ে দিয়েছে সেটা তাদের প্রকৃত চেহারা নয়। ফলে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা আর রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে দেশটির বর্তমান সরকারকে যাতে বাধ্য করা যায়, সেদিকেই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।