রাশেদুল ইসলাম রাসেদ,স্টাফ রিপোর্টার:: গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে সরকারি রাস্তা জবর দখলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে উপজেলার কঞ্চিবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মনোয়ার আলম সরকারের বিরুদ্ধে। রেকর্ডভুক্ত সরকারি রাস্তা দখল করে করা হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের প্রাচীর নির্মাণ। একই সাথে রাম্তার অতি পুরাতন ছায়া দানকারী একটি ফলবান গাবগাছ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই কর্তন করে বিক্রি করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
শুধু তাই নয়, জবর দখলে নেওয়া রাস্তার যায়গা রক্ষা করতে এবার এলজিইডির রাস্তার জন্য রেকর্ডভুক্ত সরকারি যায়গা বাদ দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠের ভিতরের যায়গা দখল করে, পাকা রাস্তা নির্মাণের জন্য নিজেই রাস্তা খনন করেছেন চেয়ারম্যান মনোয়ার আলম সরকার।
এসব বিষয়ে চলতি বছরের ২০ আগস্ট চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে রেকর্ডভুক্ত যায়গা দখল করে কঞ্চিবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের প্রাচীর নির্মাণ ও ওই স্থানের গাছ কর্তন এবং ঈদগাহ মাঠের যায়গা জোরপূর্বক দখল করে সরকারি রাস্তা নিমার্ণের অপপায়তারার বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশানের কাছে ঈদগাহ মাঠ কমিটির পক্ষে একটি লিখিত অভিযোগ করেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মোঃ খাদেম হোসেন।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবন সংলগ্ন কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠটি প্রাচীণ কাল থেকেই ঈদগাহ মাঠ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক সরকারী রেকর্ডকৃত রাস্তাটি প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ায় জনসাধারণ ঈদগাহ মাঠের উপর দিয়ে চলাচল করে। জনসাধারণের সুবিধার্তে রাস্তাটি বন্ধ করেনি মুসুল্লীগণ। কিন্তু সম্প্রতি তিস্তা সেতু সংযোগ সড়ক (এলজিইডি কর্তৃক) নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করায় এই রাস্তাটিও পাকা করণের জন্য নির্ধারণ করে কর্তৃপক্ষ। ফলে সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ার, নকশাকারক ও উর্ধতন কর্তৃপক্ষ সড়কটি নির্মাণে ইস্টিমেট তৈরির জন্য সরেজমিনে আসলে দেখা যায়, ইউপি কমপ্লেক্স ভবনের সম্মুখের মাঠ থেকে ০৪ শতক ও ঈদগাহ মাঠ থেকে হাফ (অর্ধেক) শতক জমি হুকুম দখল করে রাস্তাটি পাকা করণের জন্য নির্ধারণ করে। যা লালচিহ্নিত অবস্থায় রয়েছে।
কিন্তু কঞ্চিবাড়ী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মনোয়ার আলম সরকার জোড় পূর্বক ঈদগাহ মাঠের উপর দিয়ে সম্পূর্ণ রাস্তাটি পাকা করণের জন্য ঠিকাদার কর্তৃক মাটি খননের স্থির সিন্ধান্ত নেয় এবং খননের কাজ শুরু করে। পরে ঈদগাহ মাঠ কমিটি, মুসুল্লী ও স্থানীয় জনগণ ঈদগাহ মাঠের পবিত্রতা রক্ষায় এলজিইডি কর্তৃক ইস্টিমেট কৃত ম্যাপিং স্পট দিয়ে রাস্তাটি নির্মাণের দাবিতে উপজেলা চেয়ারম্যানের দারস্ত হয়। কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যান সমাধানের চেষ্টা করে ঘটনাস্থলে গেলেও ইউপি চেয়ারম্যানের অসহযোগিতার কারণে তা সমাধান সম্ভব হয়না বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয়, চেয়ারম্যান মনোয়ার আলম সরকার চলতি বছরের ১৯ আগস্ট ওই রেকর্ডকৃত রাস্তায় অবস্থিত একটি বড় আকৃতির গাব গাছ কোন রকম টেন্ডার বা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই কর্তন করে বিক্রি করে দেন।
পরে উপজেলা প্রশাসন বিষয়টি আমলে নিয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা ভূমি কর্মকর্তাকে (এ্যসিল্যান্ড) তদন্তের নির্দেশ দিলে গত ৭ সেপ্টেম্বর উপজেলা ভূমি অফিসের একজন সার্ভেয়ার, একজন স্থানীয় সার্ভেয়ারসহ অভিযোগটি সরজমিন তদন্ত করেন চন্ডিপুর ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা মো.আতিকুর রহমান। তদন্ত শেষে গেল ১২ অক্টোবর উপজেলা প্রশাসনের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
তদন্তকারী কর্মকর্তার দাখিল করা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পরিষদের জমির দাগ সমূহ সরকারী সার্ভেয়ার ও স্থানীয় সার্ভেয়ারের যৌথ পরিমাপে দেখা যায় যে, বর্তমানে চলাচলের জন্য রাস্তাটি ফাড়ি থানার হুকুম দখলকৃত জমি ও ঈদগাহ মাঠের জমির উপর অবস্থিত। কিন্তু মৌজা ম্যাপ ও পরিমাপ অনুযায়ী রাস্তার প্রকৃত অবস্থানটি ৩৮২১ নং দাগের ব্যক্তিবর্গ ও ইউনিয়ন পরিষদ জবর দখলে রেখেছে । মৌজা ম্যাপ অনুযায়ী ৯১৩০ নং দাগের রাস্তার জমি ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন রাস্তার অংশটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জবর দখল করে প্রাচীর দ্বারা বেষ্টন করে নিয়েছেন।
এছাড়া প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ইউনিয়ন পরিষদের পশ্চিম- উত্তর কোণে রাস্তার উপর একটি গাব গাছ বর্তমানে চেয়ারম্যান সাহেব তদন্তকালের প্রায় ৮/৯ দিন (৭ সেপ্টেম্বরের পূর্বে) পূর্বে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে কর্তন করেছেন। যা ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে রক্ষিত আছে-দেখা যায় এবং প্রকৃত রাস্তাটি ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক জবরদখল হওয়ায় জনগণ বাধ্য হয়ে ঈদগাহ মাঠের উপর দিয়ে চলাচল করে।
একইসাথে প্রতিবেদনে সরকারী রাস্তা ইউনিয়ন পরিষদের জবর দখল থেকে উদ্ধারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে এবং রাস্তার উপর অবস্থিত ছায়া দানকারী ফলবান গাব গাছটি কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে, শুধু মাত্র ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যগণ কর্তৃক রেজুলেশনের মাধ্যমে কর্তন করায় বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মতামত দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কঞ্চিবাড়ী পুলিশ তদন্তকেন্দ্র সংলগ্ন উত্তর পার্শ্বে ঈদগাহ মাঠ। মাঠের পূর্ব দিকে ১২ নং কঞ্চিবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ। মাঠের পূর্বদিকে এবং ইউনিয়ন পরিষদের প্রাচীর ঘেঁষে পাকা করার জন্য খনন করে রাখা হয়েছে দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০ মিটার রাস্তা। যার উভয় দিকেই রয়েছে পাকা সড়ক। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে আছে পুরাতন একটি গাবগাছের ডালপালাসহ খন্ডিত বিভিন্ন অংশ।
এদিন ঈদগাহ মাঠের যায়গায় রাস্তার জন্য খনন করা অংশে চেয়ারম্যানের জোরপূর্বক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভারও আয়োজন করে ঈদগাহ মাঠ কমিটি। যেখানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার কয়েক’শ মানুষ। শুরুতেই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচিটিতে বাঁধা দেয় কঞ্চিবাড়ী তদন্তকেন্দ্রের পুলিশ। পরে তাদের বাঁধা উপেক্ষা করে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ এবং শেষে ওই এলাকায় একটি বিক্ষোভ মিছিল করে ঈদগাহ মাঠ কমিটিসহ আন্দোলনকারীরা। এদিনের মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা থেকে বক্তারা শান্তিপূর্ণ সভায় কঞ্চিবাড়ী তদন্তকেন্দ্রের পুলিশের অহেতুক বাঁধা দেওয়ার বিষয়টির তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান। একই সাথে জোর-জবরদখলকারী চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি করেন তারা।
ঈদগাহ মাঠের সেক্রেটারি শাহ রেজাউল করিম বলেন, প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন এই ঈদগাহ মাঠ। অথচ চেয়ারম্যান মনোয়ার আলম সরকার রাস্তার রেকর্ডকৃত যায়গা বাদ দিয়ে অবৈধ হস্তক্ষেপ করে জোরপূর্বক মাঠের ভিতর দিয়ে রাস্তা খনন করেছেন। যা আইন সংগত নয়, বেআইনি। এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে চেয়ারম্যানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। একই সাথে অবিলম্বে তারা ঈদগাহ মাঠের যায়গা বাদ দিয়ে সরকারি রেকর্ডভুক্ত স্থান দিয়ে পাকা রাস্তা করারও দাবি জানান।
এসময় লিখিত অভিযোগকারী মুক্তিযোদ্ধা খাদেম হোসেন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে হওয়া তদন্তে মাঠের ভিতর দিয়ে চলাচলকারী রাস্তা প্রকৃত রাস্তা নয় এবং চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে রেকর্ডকৃত সরকারি রাস্তার যায়গা জবর দখল করে নিয়ে প্রাচীর নির্মাণ এবং
কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া পরিষদ সংলগ্ন রাস্তার বিশাল আকৃতির একটি ছায়া দানকারী গাব গাছ কেটে নেওয়ার অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়েছে। তার পরেও চেয়ারম্যান মনোয়ার আলম কিভাবে পরিষদের চল্লিশ দিনের লেবার দিয়ে জোরপূবর্ক ঈদগাহ মাঠের যায়গায় রাস্তা খনন করে। বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়। এত কিছুর পরেও প্রশাসন নিরব কেন? তিনি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী শামসুল আরেফীন খান বলেন, যেহেতু রাস্তার ওই অংশটি নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। বিধায় ওখানে আমরা কাজ করিনি, ওই অংশে আমরা কোনো খননও করিনি।
গাছ কাটা বিষয়ে উপজেলা বন বিভাগ কর্মকর্তা খন্দকার মেহেদি হাসান বলেন, গাছটি কাটার আগে আমাদেরকে অবগত করা হয়নি।
তবে, সপ্তাহ খানেক আগে কঞ্চিবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে একটি কাটা গাছের মূল্য নির্ধারণের জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে আমাদেরকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। নিয়ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ধরণের কোনো গাছ কর্তনের প্রয়োজন হলে, কর্তনের কারণ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা মূল্য নির্ধারণের জন্য আমাদেরকে (বন বিভাগ) অবগত করবেন। বন বিভাগের মূল্য নির্ধারণের পর স্থানীয় প্রশাসন কমিটি গঠন করবে এবং এরপর টেন্ডার বা ডাকের মাধ্যমে বিক্রি করা হবে। এ গাছটির ক্ষেত্রে তা হয়নি। তবে দূর্যোগে-দূর্ঘটনার বিষয়টি ভিন্ন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কঞ্চিবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মনোয়ার আলম সরকার বলেন, “আমি কোনো সরকারি রাস্তা দখল করি নাই, রাস্তাও করিনাই। এলজিইডি রাস্তা করেছে, সেই রাস্তায় চলছে”।
পরিষদের শ্রমিক দিয়ে ঈদগাহ মাঠের যায়গায় রাস্তা খনন প্রশ্নে চেয়ারম্যান বলেন, “আমি কেন করবো? আমিতো ঠিকাদার নই। ঠিকাদার লেবার দিয়ে করেছে”।
পরিষদ সংলগ্ন রাস্তার গাছ কাটা প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি কোনো গাছ কাটি নি। তিনি দাবি করেন, রাস্তার কাজের সময় এলজিইডি ভেকু দিয়ে পরিষদের প্রাচীর ভেঙ্গে দিয়েছে এবং মাটি গভীর খনন করায় গাছটি উপড়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। তখন নিরাপত্তার জন্য গাছটি পরিষদ কাটে, তা রক্ষিত আছে।
এসময় উপজেলা প্রশাসনের কাছে ভূমি কর্মকর্তার দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদন মিথ্যা দাবি করে বিষয়টি পুণরায় তদন্তের জন্য আবেদন করা হয়েছে বলেও জানান চেয়ারম্যান।
এসব বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তারিকুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, দ্রুতই এসব ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যদি কেউ আইন লঙ্ঘন করে থাকে, তবে সেটির আইন অনুসরেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।