আবহমান কাল ধরে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের বাস বাংলাদেশে। দেহের গঠন আর রঙেও রয়েছে বৈচিত্র। রয়েছে হাজার বছরের সম্প্রীতির বন্ধন। এই বিচিত্রতা একদিকে যেমন দেশকে করেছে সৌন্দর্যময়, অন্যদিকে তেমনি সম্প্রীতির বন্ধনকে করেছে অটুট।
এদেশে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয় মুসলিমদের ঈদ, হিন্দুদের পূজা, খ্রিষ্টানদের বড়দিন এবং বৌদ্ধদের বুদ্ধপূর্ণিমা। এসব উৎসব উপভোগ করার জন্য থাকে সরকারি ছুটি। সবাই স্বাধীভাবে পালন করে থাকে নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব। বিদ্বেষ তো নেই বরং আছে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর সাহচর্য। কাছে টেনে নেয় বিভিন্ন উৎসবে তারা একে অন্যকে। বিনিময় করে একে অপরের সাথে প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
একই গ্রাম কিংবা পাড়ায় পাশাপাশি বসবাসের ফলে সম্প্রদায়গত পার্থক্য থাকলেও তা কখনো সম্প্রীতির বন্ধনে কোনো চির ধরাতে পারেনি। কিছু কিছু কুমতলববাজ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হীন স্বার্থ হাসিল করতে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিতে চাইলেও এদেশের ছাত্র-জনতা, শিক্ষকসহ অনেক রাজনৈতিক দল সাম্প্রদায়িকতাকে কখনো প্রশ্রয় দেয়নি। বরং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ খেত-খামার, কল-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অফিস-আদালতসহ নানা কর্মক্ষেত্রে। শরিক হয়েছে সুখে-দুঃখে একে অন্যের। গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাক্ষর হয়ে আছে নানা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে গভীর সংহতি ও ঐক্যের। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সকল সম্প্রদায়ের মানুষ।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি, ব্যবসায়, বাণিজ্য, চাকুরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সকল মানুষের সমান সুযোগ এবং অধিকার স্বীকৃত। সব ক্ষেত্রে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সমান সুযোগ ও অধিকার স্বীকৃত।
মদিনা সনদের একটি ধারা ছিল পৌত্তলিক, ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমসহ সকল সম্প্রদায়ের মানুষ এক উম্মাহভুক্ত।
আল্লাহর রসুল হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন,’সাবধান! যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের ওপর অত্যাচার করে বা তার অধিকার কম দেয় কিংবা সামর্থ বহির্ভূতভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয় অথবা জোর করে তার কোনো সম্পদ জোর করে নিয়ে যায়, তবে কেয়ামতের দিন আমি সে ব্যক্তির বিরুদ্ধে নালিশ করবো।’ (আবু দাউদ)।
‘চতুর্দশ খৃষ্টাব্দের বৈষ্ণব কবি চন্ডীদাস বলেছেন, শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
বস্তুত, এদেশে সংখ্যালঘিষ্ঠ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বলতে কোনো শব্দ নেই। সবার একটাই পরিচয় আমরা বাংলাদেশী।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, দেশে দেশে শাসকগোষ্ঠীর হীন স্বার্থে তাদেরই প্ররোচনায় হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ ও শুভবুদ্ধির কাছে তা পরাজিত হয়। হিংসা নয়, স্নেহ, ভালোবাসা ও সম্প্রীতির মধ্যেই মানুষ বেঁচে থাকে। সাধারণ মানুষের অশিক্ষা ও কুশিক্ষার সুযোগে ক্ষমতাধর সুবিধাভোগী শ্রেণী সাম্প্রদায়িকতার মতো মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটাতে সাহস পায়। তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে মানুষকে উদার মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ কবিতার মতো ডাক দিয়ে বলতে হবে:
হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।
এদেশের প্রতিটি মানুষ নদীর পাশ দিয়ে যখন পথ চলতে গিয়ে দেখেন একটা লোক ডুবে মরছে, বিবেকের তাড়নায় তখন তার মনে এই প্রশ্ন উঁকি দেয়না যে, লোকটি হিন্দু না কি মুসলিম, বৌদ্ধ না কি খ্রিস্টান! বরং তাকে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। মনে আত্মতৃপ্তি পেয়ে বলে, ‘যাক, একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি তো।’ বস্তুত, সকল বিপদ-আপদে এক সম্প্রদায়ের দুঃখে অন্য সম্প্রদায় বাড়িয়ে দিয়েছে সহানুভূতির হাত। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে কখনো ব্যক্তিগত আক্রোশ, কখনোবা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে তা নস্যাৎ করার চেষ্টা করলেও কখনো সফল হয়নি। রুখে দিয়েছে তা সম্মিলিতভাবে।
সে যাই হোক, কোনো দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ যাতে যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে না পারে সে জন্য ধর্মীয় অনুশাসনগুলো প্রতিপালনের পাশাপাশি সবকিছু বিচার করতে হবে যুক্তি দিয়ে। প্রসার ঘটাতে হবে আমাদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির। চর্চা করতে হবে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মুক্তবুদ্ধির। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে কি না তা উপলব্ধি করতে হবে নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে। আর ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনার তদন্ত করে নিশ্চিত করতে হবে তার বিচার।
সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে। রুখে দিতে হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে চির ধরাতে চাওয়া অপশক্তিকে। তাহলেই বজায় থাকবে আমাদের সম্প্রীতির বন্ধন। গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন সমাজ ও দেশ। সেই প্রত্যাশা সবার।
এম এ মাসুদ
কলাম লেখক
ই-মেইল:masud.org2018@gmail.com