বাংলাদেশে পাওয়া যায় এমন সব মাছের মধ্যে
ইলিশ হলো বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় মাছ। স্বাদ,গন্ধ ও রূপে অন্যান্য সব মাছকে টপকে বাঙালি সমাজে জাতীয় মাছ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ইলিশ। ইলিশের নাম শুনলেই জিহ্বায় জল চলে আসে যে কারো। প্রায় একযুগ আগেও স্বাদে,গন্ধে অতুলনীয় এ মাছ পাওয়া যেত গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে। দামেও ছিল বেশ সস্তা। দাম কম বলে সব শ্রেণি পেশার মানুষের নাগালের মধ্যে ছিল জাতীয় মাছ ইলিশ।
স্কুলে গেলে শিক্ষকরা ঘ্রাণ পেয়ে বলতে পারতেন কোন শিক্ষার্থী ইলিশ মাছ খেয়ে এসেছে! কোনো বাড়িতে ইলিশ রান্না হলে তার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তো আশপাশের বাড়িতে। যুগ যুগ ধরে বাঙালি সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ বলে বিবেচিত হয়ে আসা বাংলাদেশের ইলিশ এখন আন্তর্জাতিকভাবেও ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইলিশ গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে ইলিশের আহরণ প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। বিশ্বের ১১টি দেশের মধ্যে ১০টিতে উৎপাদন কমলেও উৎপাদন বাড়ছে কেবল বাংলাদেশে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি দপ্তরের (ফাও) তথ্যানুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশের উৎস বাংলাদেশে। ওয়ার্ল্ডফিশ এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অথিদপ্তরের তথ্যও তাই বলছে। চার বছর আগেও এই উৎপাদনের হার ছিল ৬৫ শতাংশ। নানা কার্যকর পদক্ষেপের ফলে ধারাবাহিকভাবে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে বলে মনে করেন মৎস্য গবেষকরা।
গেল ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদিত ইলিশের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার টন।
কিন্তু দেশে এত বিপুল পরিমাণ ইলিশ আহরণ করা হলেও ২০১২ সাল থেকে রপ্তানি তালিকায় তা অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় জাতীয় মাছ ইলিশ থেকে যাচ্ছে গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। আমদানি-রপ্তানি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। দেশের মানুষের চাহিদা পূরণের পরেই না কোনো দেশ তার উদ্বৃত্ত পণ্য রপ্তানি করে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে বিদেশে ইলিশ রপ্তানি হওয়ায় আজ হাটে-বাজারে ইলিশের আকাল। দামও আকাশচুম্বী। বাঙালি ঐতিহ্যের ধারক এই মাছ থেকে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। পাঠ্য বইয়ে শিশুরা জাতীয় মাছ ইলিশের ছবি দেখলেও বাস্তবে তার স্বাদ ও ঘ্রাণ নিতে পারছে ক'জন!
বাংলাদেশের মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ওয়ার্ল্ডফিস- এর যৌথ গবেষণা বলছে, গত ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে পাওয়া যেত ইলিশ। বর্তমানে ১২৫ থেকে ১৩০টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। দেশে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে ইলিশের অভয়াশ্রম। বাংলাদেশে সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সাগর থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ায় ইলিশের উৎপাদন ব্যহত যাচ্ছে-এমন অভিমত মৎস্য বিশেষজ্ঞদের।
তবে ইলিশ যাতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আসে সে জন্য দেশের মানুষের চাহিদা না মিটিয়ে ইলিশ মাছ রফতানি করা হবে না বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তার কথায় আশ্বস্ত হয়েছেন দেশের মানুষ।
এমন সিদ্ধান্তের পাশাপাশি মেঘনা ও পদ্মা নদীর দূষণ রোধ, অবৈধভাবে মৎস্য আহরণ ও পাচার রোধ, আহরণ থেকে দেশের হাট-বাজরে পৌঁছা পর্যন্ত দাম মনিটরিংসহ মৎস্য আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারলে ইলিশের অভয়াশ্রম হয়ে উঠবে দেশের নদ-নদী। বাড়বে উৎপাদন। আর দাম কমে সাধারণ মানুষের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে আসবে স্বাদ, ঘ্রাণ ও খাদ্যমানে ভরা রুপালি ইলিশ এমন প্রত্যাশা সবার।
লেখক: এম এ মাসুদ
সংবাদকর্মী ও কলাম লেখক