আশরাফুল হক, লালমনিরহাট::লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী খাদ্যগুদামের পরিদর্শক ফেরদৌস আলম চাল হিসেবে গোজামিল দিতে খাদ্যগুদামের খামালে সুড়ঙ্গ রেখেছেন সরকারী চাল তছরুপের দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া পরিদর্শক।
গণনা শুরুর ২ দিনে ১৭ খামালের ৩ টিতে ১শত ৪০ মেঃ টন চাল কম পেয়েছে তদন্ত টিম। তছরুপকৃত চালের পরিমাণ ৩ শত মেঃ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে। সরকারী চাল তছরুপ করার দায়ে গ্রেপ্তার খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা খাদ্য পরিদর্শক ফেরদৌস আলমকে রোববার আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে শুক্রবার কালীগঞ্জ থানার দায়ের করা মামলাটি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর আঞ্চলিক কার্যালয় কুড়িগ্রামে পাঠিয়েছে পুলিশ। কালীগঞ্জ উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এনামুল হক বাদি হয়ে দুদক আইনে মামলাটি দায়ের করলে শনিবার তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সরকারী চাল তছরুপের ঘটনা তদন্তে ৫ কর্মদিবস সময় দিয়ে শুক্রবার চার সদস্যে তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক। তদন্ত কমিটি ও স্থানীয় প্রশাসন অভিযান চালিয়ে প্রথম দিনই দুই দফায় সাড়ে ৫৪ মেঃ টন চাল উদ্ধার করে জব্দ করেন। বিভিন্ন সুত্রের খবরে কয়েকটি অভিযান চালালেও সফল হয়নি প্রশাসনের অভিযান। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ভোরে ২৫ টি ট্রলিতে গুদাম থেকে ২৫০ মেঃটন চাল সড়িয়ে আত্নগোপন হন গুদাম কর্মকর্তা। এমন খবরে তাৎক্ষনিক অভিযান চালিয়ে গুদাম সিলগালা করেন কালীগঞ্জ ইউএনও জহির ইমাম। তদন্ত কমিটি গুদামে তছরুপ হওয়া চালের সঠিক পরিমাপ নির্ধারন করতে গুদামের প্রতিটি বস্তা পরিমাপ করে আলাদা করা হচ্ছে। এতে প্রতিটি খামালে সুড়ঙ্গ খুজে পায় তদন্ত কমিটি। এই সুড়ঙ্গ থেকে চালের গোজামিল হিসেব দিতেন গুদাম কর্মকর্তা ফেরদৌস আলম। তদন্ত কমিটির পরিমাপ টিমটি গত দুই দিনে ১৭ টি খামালের মাত্র ৩ টি খামাল পরিমাপ করতে সক্ষম হয়েছেন। তিন খামাল থেকে প্রায় ১শত ৪০ মেঃ টন চাল কম পেয়েছে তদন্ত টিম।
সুড়ঙ্গের বিষয়ে গুদাম শ্রমিকরা জানান, প্রতি এক/দুই মাস পর পর গুদাম পরিদর্শন হয়। সেই পরিদর্শনে গুদামের খামাল এবং প্রতি খামালে কতটি সারি ও প্রতি সারিতে কতটি বস্তা রয়েছে তা খাতার সাথে মিল রয়েছে কি না। সেটা দেখেন মাত্র। এ কারনে খামালে সুড়ঙ্গ রাখেন ফেরদৌস। শ্রমিকরা বিষয়টি জানলেও তা প্রকাশ না করতে করাকরি আরোপ ছিল গুদামে।
স্থানীয় চাল ব্যবসায়ী ও নিবন্ধিত চাল কল মালিকরা (মিলার) জানান, ভোটমারী খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা ফেরদৌস আলমের পছন্দের কয়েকজন মিলার রয়েছে। এসব মিলারকে আগাম ডিও (টাকা) প্রদান করে থাকেন। সেই টাকা নিয়ে মিলাররা চাল তৈরী করে বা কিনে গুদামে দেন। এর মধ্যে দু/একজন টাকা নিয়েও চাল না দেয়ায় সংকটে পড়েন ফেরদৌস। এ ছাড়াও গত বোরো মৌসুমে ৩০ জন নিবন্ধিত ও চুক্তিপত্র করার মিলারের মধ্যে ২৪ জনের বরাদ্ধের চাল ফেরদৌস নিজে গুদামে দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। এসব কাজে বেশ সহায়তা করতেন মিলার শফিকুল ইসলাম, এরশাদ হোসেন, ইউনুস আশরাফি, কলেজ শিক্ষক ও মিলার শাহীন এবং আওয়ামীলীগ নেতা কাঞ্চন ও বদিয়ার। এর আগেও কাঞ্চন গুদামের চাল কিনে তা মিনিকেট লেখা প্যাকেট করে বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে গুদাম সিলগালা করেছিল প্রশাসন। কিন্তু তৎকালিন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহম্মদের খুব কাছের লোক হওয়ায় বেঁচে যান কাঞ্চন। গুদাম বর্মকর্তা ফেরদৌস আলমের বটগাছ ছিল আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা কাঞ্চন। ফেরদৌস আলম গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে এসব মিলার ও সেল্টারদাতারা আত্নগোপন রয়েছেন।
খাদ্য বিভাগের একটি দায়িত্বশীল সুত্র দাবি করছেন, ফেরদৌস আলম বৃহস্পতিবার গুদাম থেকে মিলার এরশাদকে ৫০ মেঃ টন চাল দিয়েছেন। যা ওই বৃহস্পতিবার ভোরেই রংপুর চলে যায়। বিক্রি করে টাকা শফিকুলকে দেয়ার কথা থাকলেও এরশাদ আত্নসাৎ করেছেন বলে সুত্রটি দাবি করেছে। তবে ফেরদৌসের প্রিয় মিলাররা আত্নগোপনে থাকায় এর সঠিকতা নিরুপন করা সম্ভব হয়নি। খাদ্য বিভাগের অপর একটি সুত্র বলছে, তছরুপ হওয়া আড়াই/তিনশত মেঃ টন চাল একদিনে গুদাম থেকে গোপনে সড়ানো অসম্ভব। ধারনা করা হচ্ছে, যে ২৪ জন মিলারের চাল ফেরদৌস নিজে গুদামে ক্রয় দেখিয়েছেন। তা হয়তো কাগজ কলমে ক্রয় দেখানো হয়েছে। আর এ সংকট গোজামিল দিতে খামালে সুড়ঙ্গ রেখেছেন। তিনি চাল নয়, সরকারী টাকা তছরুপ করেছেন। এজন্য বোরো মৌসুমে গুদামে চাল দেয়া মিলারদের জিজ্ঞাসাবাদ করার দাবি করেছে সুত্রটি। এমনটি হলে তদারকি কর্মকর্তা হিসেবে উপজেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক দায় এড়াতে পারেন না। কারন, ডিওতে স্বাক্ষর করলে সে চাল গুদামে পৌছানো হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করাও তার দায়িত্ব পড়ে।
অভিযানে প্রথম দফায় একরামুল হকের সুটার মিল থেকে ৩০ মেঃ টন চাল উদ্ধার করা হয়। সেই একরামুল হক বলেন, পুরো উপজেলার মিলার, সাধারন চাল ব্যবসায়ী ও সরকারী গুদাম থেকেও চাল আসে আমার সুটার মিলে। কারন, এটিই একমাত্র সুটার মিল। ওই দিন তিনটি ট্রাকে ৩০ মেঃ টন চাল সুটার করতে পাঠান স্থানীয় মিলার শফিকুল। যা পরবর্তিতে প্রশাসন জব্দ করে। এই শফিকুলের সাথে গুদাম কর্মকর্তা ফেরদৌস আলমের বেশ সখ্যতা রয়েছে। চাল জব্দ এবং ফেরদৌস গ্রেপ্তারের পর থেকে শফিকুল অনেকটা আত্নগোপনে।
তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক (ভার) স্বপন কুমার দে বলেন, গুদামে ১৭ টি খামালের মাত্র ৩ টি পরিমাপ করে রেজিস্টার অনুযায়ী ১ শত ৪০ মেঃ টন চাল কম পেয়েছি। প্রতিটিতে সুড়ঙ্গ ছিল। তদন্ত চলমান রয়েছে। ৫ কর্মদিবসে তদন্ত শেষ করা সম্ভব হবে না তাই সময় বাড়িয়ে নেয়া হবে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, কি পরিমান চাল তছরুপ হয়েছে তা আগে নির্ণয় করতে হবে। তাই প্রতিটি বস্তা পরিমাপ করছে তদন্ত কমিটি। অপর দিকে বিভিন্ন তথ্যে একাধিক অভিযান চালিয়েছি কিন্তু চাল পাওয়া যায়নি। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গ্রেপ্তার গুদাম কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তারাও ঘটনা তদন্ত করবেন।