কয়েক মাস বিরতির পর দেশে করোনা সংক্রমণের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। হাসপাতালেও বেড়েছে রোগী ভর্তির সংখ্যা।
দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতেই সরকারি ল্যাবরেটরিগুলো থেকে এমন পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। শীত আরও বাড়লে সংক্রমণও বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ অবস্থায় তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস থেকে সুরক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। অন্যথায় করোনার বিস্তার ও মৃত্যু দুই-ই বাড়বে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নভেম্বরের শুরু থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী শনাক্তের হার ছিল ১৮ শতাংশ। ১৯ নভেম্বর থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত শনাক্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এক মাসের ব্যবধানে সংক্রমণের হার এভাবে বেড়েছে। একই সময় মৃত্যুর সংখ্যা ৩৬৯ দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া বিদেশগামী যাত্রী, যাদের কোনো লক্ষণ-উপসর্গ নেই, কোভিড-১৯ পরীক্ষায় তাদের ক্ষেত্রেও এক দশমিক ১৬ শতাংশ মানুষের করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে।
বিদেশগামী যাত্রীদের কোভিড-১৯ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার পর বিদেশগামী সব সুস্থ মানুষই কোভিড-১৯ পরীক্ষা করাতে আসে। কিন্তু তাদেরও একটি অংশ রোগটিতে আক্রান্ত বলে প্রমাণ মিলছে।
এটা নিয়ে বেশি চিন্তিত বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এখান থেকে সংক্রমণের হার অনুমান করা যাচ্ছে। তারা বলছেন, শীতে দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়বে, এটা আগেই ধারণা করা হয়েছিল। বিশেষত স্বাস্থ্যবিধি না মানা, আবহাওয়া, শীতজনিত রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে।
দেশে সবচেয়ে বেশি কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা হয় ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে। মঙ্গলবার পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৭ লাখ ৩১ হাজার ১৮১টি। এর মধ্যে এই ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা হয়েছে ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৬৫৯টি। এমনকি মঙ্গলবারও মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৯ হাজার ৭৮৮টি। যার মধ্যে ২ হাজার ২৫৯টির পরীক্ষা হয়েছে এখানে।
এই প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত নমুনায় শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ব্র্যাকের নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র থেকে এই সময় প্রতিষ্ঠানটিতে ৫ হাজার ৭৮৭টি নমুনা পাঠানো হয়েছে। যার মধ্যে কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়েছে ১৭২৮টি নমুনা।
অর্থাৎ শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ। অথচ একই প্রতিষ্ঠানে ১০ নভেম্বর থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত ব্র্যাকের বুথ থেকে নমুনা এসেছে ৪ হাজার ১৮৪টি। এর মধ্যে পজিটিভ হয়েছে ৭৭৬টি। অর্থাৎ ওই সময় শনাক্তের হার ছিল ১৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, আগেই ধারণা করা হয়েছিল শীতে সংক্রমণের হার বাড়বে। বর্তমানে শনাক্তের হার বাড়ায় সেই ধারণা প্রমাণিত হয়েছে। এভাবে শংক্রমণের হার বৃদ্ধি উদ্বেগজনক।
এদিকে দেশের আরেকটি বড় ল্যাবরেটরি হল ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন-নিপসম। এই ল্যাবের ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. জামালউদ্দিন সাইফ যুগান্তরকে জানান, দুই সপ্তাহ ধরে শনাক্ত বাড়তে শুরু করেছে। এমনকি বিদেশগামীদের ক্ষেত্রে শনাক্তের হার বেশি দেখা যাচ্ছে।
প্রতি প্লেটে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত শানাক্ত হতো ১০ থেকে ১২টি নমুনা। কিন্তু গত দুই সপ্তাহ শনাক্তের হার প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এখন প্রতি প্লেটে শনাক্ত হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০টি নমুনা। (পিসিআর মেশিনে একবারে ৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করা যায়। একবারের এই পরীক্ষার সব নমুনা একটি প্লেটে মেশিনে দেয়া হয়।) তিনি বলেন, একটু ঠাণ্ডা পড়তেই শনাক্ত বাড়তে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা আরও বাড়লে কী হবে, সেটা সহজেই অনুমেয়।
এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, তার ল্যাবেও শনাক্তের হার ঊর্ধ্বমুখী। শনাক্ত মাঝখানে কিছুটা কমে এলেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বাড়ছে। পর্যটন কেন্দ্র, কমিউনিটি সেন্টার, ওয়াজ মাহফিলের মতো জনসমাগম যেগুলো জীবন ও জীবিকার জন্য জরুরি না, সেগুলো বন্ধ করে দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন হাজার হাজার মানুষের একত্র হওয়া বন্ধ করা জরুরি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান যুগান্তরকে বলেন, সংক্রমণও বাড়ছে, মৃত্যুও বাড়ছে। তবে এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, সারা বিশ্বেই বাড়ছে। এজন্য শুধু শীত একমাত্র কারণ নয়। অন্যতম কারণ, স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোয়া ইত্যাদিতে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু নানা কারণে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব দেখা দিয়েছে। শীতজনিত অনেক রোগ ও ফুসফুসজনিত সমস্যা বাড়ে। এসব কারণে মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষামতা কমে যায়। ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বাঁচতে হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ স্বাচিপ সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান যুগান্তরকে বলেন, হাসপাতালগুলোয় ভর্তি রোগী বেড়েছে। এটা থেকেই বোঝা যায়, দেশে সংক্রমণের হার বেড়েছে। তিনি বলেন, আমরা শুধু সরকারি হাসপাতাল হিসাবে নিচ্ছি, কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের খবর নিলেই একই চিত্র পাওয়া যাবে। আমরা দেখছি সংক্রমণ বাড়ছে, যেটা তিন-চার সপ্তাহ আগেও ছিল না। এটা আরও বাড়তে পারে। কারণ জনসামাবেশ বেড়েছে, জনগণের মধ্যে মাস্ক ব্যবহারের প্রতি অনীহা তৈরি হয়েছে, শারীরিক দূরত্ব বজায় না রাখা-এসব কারণে সংক্রমণ বাড়ছে।
তবে আইইডিসিআর এর উপদেষ্টা ড. মোশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, একটি বা দুটি ল্যাবের ডাটা দিয়ে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা কঠিন। অন্য ল্যাবের সঙ্গে তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখাতে হবে। যেহেতু সামগ্রিকভাবে দেশে রোগী শনাক্তের হার বেড়েছে তাই সবাইকে সাবধানতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেন তিনি।
করোনায় মৃত্যু ৩৫ শনাক্ত ২৩১৬ : দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একদিনে আরও ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ২ হাজার ৩১৬ জন। এতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৭১ হাজার ৭৩৯ । রোগটিতে এপর্যন্ত মারা গেছেন ৬ হাজার ৭৪৮ জন। বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়েছে, গত একদিনে বাসা ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ২ হাজার ৫৯৩ জন রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন। সব মিলে এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৩৭৯ জন ।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১১৮টি ল্যাবে ১৬ হাজার ৮০৭টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ২৮ লাখ ২০ হাজার ৯৮১টি নমুনা। একদিনে নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ, এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮২ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এই সময়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে ২৩ জন পুরুষ, ১২ জন নারী । তাদের সবাই হাসপাতালে মারা গেছেন। এদের মধ্যে ২৩ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, ১০ জনের বয়স ৪১ থেকে ৬০ এবং ২ জনের বয়স ১১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ছিল।
মৃতদের মধ্যে ২২ জন ঢাকা বিভাগের, ৫ জন ময়মনসিংহ, ৩ জন করে মোট ৬ জন চট্টগ্রাম ও রংপুর বিভাগের এবং ১ জন করে মোট ২ জন রাজশাহী ও বরিশাল বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন।
এযাবত যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৫ হাজার ১৬৪ জনই পুরুষ এবং ১ হাজার ৫৮৪ জন নারী। তাদের ৩ হাজার ৫৯৮ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি। এছাড়াও ১ হাজার ৭৫২ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, ৮১২ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে, ৩৪৭ জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে, ১৫১ জনের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, ৫৫ জনের বয়স ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এবং ৩৩ জনের বয়স ছিল ১০ বছরের কম। এদের ৩ হাজার ৬৪০ জন ঢাকা বিভাগের, ১ হাজার ২৬৯ জন চট্টগ্রাম, ৪০৯ জন রাজশাহী , ৪৯৯ জন খুলনা, ২২০ জন বরিশাল, ২৬৬ জন সিলেট, ৩০৬ জন রংপুর এবং ১৩৯ জন ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন।