মাহবুবুর রহমান,লালমনিরহাট: ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমি থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের বিতারিত করে বিজয় আনন্দে মেতে উঠে উত্তরের সীমান্তবর্তী রেলওয়ে আর বিহারি অধ্যুষিত জেলা লালমনিরহাটের মানুষ।
প্রবীণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ণনায় জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষনায় বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ মাতৃকাকে হানাদার মুক্ত করতে উজ্জ্বীবিত হয়ে উঠে। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সরকারের নির্দেশে পাকসেনারা নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দেশকে শত্রুমুক্ত করে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে জীবনবাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্তরের মানুষ। সারাদেশের মতোই উত্তাল হয়ে ওঠে বিহারি অধ্যুষিত রেলওয়ের বিভাগীয় শহর লালমনিরহাটের পাড়া-মহল্লা।
২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৭ মার্চ দুপুরে লালমনিরহাটের মুক্তিকামী মানুষ মিছিল নিয়ে রেলওয়ের আপইয়ার্ড কলোনি পার হওয়ার সময় পাকিস্তানিদের সঙ্গে গোলাগুলি শুরু হয়। পাকিস্তানি ইপিআর জিয়াউল হকের গুলিতে মারা যান শহীদ শাহজাহান। প্রথম শহীদ শাহজাহানকে তার বাড়ির পাশে দাফন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে লালমনিরহাটে ২৯জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া গেলেও অসংখ্য শহীদের মরদেহের সন্ধান মেলেনি।
পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করতে গঠিত হয় রাজাকার আল বদর, আল সামস। তারাও পাকসেনাদের সাথে যুক্ত হয়ে নিরস্ত্র বাঙালির উপর নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। তারা মা-বোনদের সম্ভ্রম হানি করে প্রতিটি বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। রেলওয়ের শহর লালমনিরহাটের নিরস্ত্র বাঙালিদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন ও হত্যা করে তৎকালিন ডিআরএম ভবনের পিছনের ডোবায় মরদেহ ফেলে রাখে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা। পরবর্তীতে ডিআরএম ভবনের পিছনটা গণকবর হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। পরবর্তীতে সংরক্ষণ করা হয় ৭১ এর সেই গণকবর। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলীসহ মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে জাতি আজও স্মরণ করে বীর শহীদদের।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় দেশে মোট ১১টি সেক্টরের মধ্যে লালমনিরহাট অঞ্চল ছিল ৬ নং সেক্টরের অধীনে। দেশের অভ্যন্তরে থাকা একমাত্র ৬ নং সেক্টরটি ছিল পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী হাসর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ সেক্টরের কমান্ডর ছিলেন এম, খাদেমুল বাশার। তার দক্ষ নেতৃত্বে ও সাহসী পদক্ষেপে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে এ সেক্টর পরিদর্শনে আসেন তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদ। প্রধানমন্ত্রীর পদচারণায় আরও সাহসী হয়ে ওঠে ৬ নং সেক্টরের সম্মিলিত বাহিনী।
২৮ ও ২৯ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রবল আক্রমণ চালালে ৩০ নভেম্বর জেলার হাতীবান্ধা উপজেলা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। ৪ ডিসেম্বর কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার বড়বাড়ি আইরখামারে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর মারাত্মক আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী। প্রবল আক্রমণের মুখে দিশেহারা পাকিস্তানি বাহিনী বিতারিত হলেও পরদিন পুনরায় বড়বাড়ি আইরখামারে আক্রমণ চালায়। জ্বালিয়ে দেয় বেশ কিছু ঘর বাড়ি। ৫ ডিসেম্বর বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে রাতভর প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী।
অবশেষে ৬ ডিসেম্বর ভোরে বিকট শব্দে তিস্তা রেল সেতু উড়িয়ে দিয়ে শেষ বারের মত লালমনিরহাট ত্যাগ করে রংপুর ও সৈয়দপুর সেনানিবাসে পালিয়ে যায় পাকসেনারা। আর তাদের দোসর রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্নসমর্পণ করে। মুক্তির আনন্দে বিজয় উল্লাসে মেতে উঠে জেলার আমজনতা। বিজয় মিছিলে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো লালমনিরহাট জেলা। দেশের আকাশে পতপত করে উড়তে থাকে জাতীয় পতাকা। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য এ জেলার কৃতী সন্তান শহীদ ক্যাপ্টেন তমিজ উদ্দিন বীর বিক্রম ও ক্যাপ্টেন (অব.) আজিজুল হক বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।
৬ নং সেক্টরের বড়বাড়ি আইরখামার এলাকায় শেষ সম্মুখ যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে আদিতমারীর হাজিগঞ্জ এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরল হক জানান, ৪ ডিসেম্বর রাতভর যুদ্ধ করে বড়বাড়ি থেকে পাকসেনাদের বিতারিত করা হয়। কিন্তু পরদিন পুনরায় তারা রাজাকারদের আহ্বানে বাঙালির ওপর আক্রমণ করলে ৫ ডিসেম্বর রাতে আবারও তুমুল বেগে আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে রাতভর আক্রমণে পরদিন ভোরে পাকসেনারা পালিয়ে যায়। ওই দিন বেশ কিছু সহযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধে পিপাসার্ত হয়ে মানুষের মলযুক্ত ডোবার পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করেছি।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, ৬ ডিসেম্বর লালমনিরহাট মুক্ত দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা ও র্যালির আয়োজন করা হয়েছে। অবিস্মরণীয় এই দিনটি যথাযথভাবে উদযাপনের জন্য লালমনিরহাটের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সাংবাদিকরা ও জেলা প্রশাসন বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।