আশরাফুল হক, লালমনিরহাট।। দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ, প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৯০ সালে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের পিত্তিফাটা নামক স্থানে তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়। উত্তর জনপদের বৃহত্তর রংপুরসহ আশপাশের ৪-৫ জেলার অনাবাদী জমিতে সেচ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বাড়তি ফসল উৎপাদনের লক্ষে ব্যারেজটি নির্মিত হলেও সুষ্ঠু ব্যবহারের অভাবে এটি ২ জেলার মানুষের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে।
১৯৯০ সালের ৫ আগস্ট ব্যারেজটি উদ্বোধন করা হয়। এটি সাধারণ জনগণ ও স্থানীয়দের কাছে ডালিয়া ব্রিজ নামেও পরিচিত। নির্মাণকালে প্রকল্পে ব্যারেজের পূর্ব ও পশ্চিম তীর রক্ষা বাঁধের কথা থাকলেও সে সময় শুধু পশ্চিম তীর রক্ষা বাঁধ নির্মিত হয়। কিন্তু পূর্ব তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। তিস্তা ব্যারেজ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র থেকে জানা যায়, ৬১৫ মিটার দীর্ঘ এ ব্যারেজে ৫২ টি গেট রয়েছে। এরমধ্যে ৪৪ টি গেট তিস্তা নদীর মূল ধারা প্রবাহের এবং বাকী ৮ টি গেট সেচ প্রকল্পের জন্য তৈরি করা হয়। সেচ প্রকল্প নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সিলট্রাফও খনন করা হয়। ব্যারাজের স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ৫২ দশমিক ৪০ সেমি। স্বাভাবিক সময়ে পানি প্রবাহ ২০ হাজার কিউসেক ধরা হলেও ৪ লাখ কিউসেক পর্যন্ত পানি ধারণ ক্ষমতা রয়েছে এ ব্যারেজের। তবে পানি এর চেয়ে বৃদ্ধি পেলে ব্যারেজ রক্ষার লক্ষে লালমনিরহাট অংশে করা হয়েছে বাইপাস সড়ক। ৫২ টি গেটের মধ্যে শুধু শুষ্ক মৌসুমে ৮ টি গেটের পানি সিলট্রাফ হয়ে সেচ ক্যানেল দিয়ে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে নেওয়া হয়। কিন্তু গত বছর প্রয়োজনীয় পানির অভাবে মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
এদিকে, বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানিতে বন্যা দেখা দিলেও পশ্চিম তীর রক্ষা বাঁধ থাকায় পানি সেচ ক্যানেলে না যাওয়ায় রংপুর, নীলফামারী ও দিনাজপুর অঞ্চলে বন্যার তেমন প্রকোপ থাকে না। ফলে এ অঞ্চলের ৮০ হাজার হেক্টর জমির কৃষকদের কাছে তিস্তা ব্যারেজ বর্ষা মৌসুমেও আর্শীবাদ স্বরুপ। অপরদিকে, বাকী ৪৪ টি গেট দিয়ে বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি তিস্তার মূলধারায় প্রবাহিত হয়। কিন্তু পূর্ব তীর রক্ষা বাঁধ না থাকায় এ সময়ে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামসহ এ অঞ্চলে দেখা দেয় বন্যা। নষ্ট হয়ে যায় বিপুলপরিমাণ কৃষিপণ্য ও বিভিন্ন ফসল। একই রকম দুর্ভোগ পোহাতে হয় শুষ্ক মৌসুমেও। এ সময় খরা আর তিস্তায় পানি না থাকায় মরুভূমিতে পরিণত হয় লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার বৃহৎ এলাকা।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে কথা বলে জানা যায়, ব্যারেজ নির্মাণকালে তিস্তার উভয় তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে নির্দিষ্ট পথে নদীর মূলধারা প্রবাহের কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে এখনো অরক্ষিত রয়ে গেছে বাম তীর। ফলে বালি জমে গিয়ে তিস্তা তার নাব্যতা হারিয়ে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার লোকালয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তার পানি। এতে উভয় তীরের ব্যবধান দাঁড়িয়েছে বর্তমানে প্রায় ১২-১৪ কিলোমিটারের মতো। ফলে প্রতিবছরই পূর্ব তীরের লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার ২৬ টি ইউনিয়নের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বর্ষাকালে বন্যা, পানিবন্দি ও নদীভাঙনের সঙ্গে মোকাবেলা করে টিকে থাকছে। অপরদিকে শুষ্ক মৌসুমে মরুময়তার সঙ্গে নিত্য লড়াই করতে হচ্ছে তাদের। শুধু পূর্ব তীর রক্ষা বাঁধ না থাকায় তিস্তা ব্যারেজের বৃহৎ সুফলের ছিঁটেফোটাও পাচ্ছেন না এই দুই জেলার সাধারণ মানুষ ও কৃষকরা।
তিস্তার পূর্ব তীর রক্ষা কমিটির তথ্যমতে, ব্যারেজ নির্মাণের ২৫ বছরে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমি তিস্তাগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অনাবাদী হয়েছে প্রায় এক লাখ হেক্টর আর বালুচরে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমি। এ সময়ে গৃহহারা হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার পরিবার।
তিস্তার পূর্ব তীর রক্ষা কমিটির সভাপতি হাতীবান্ধা আলিমুদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সরওয়ার হায়াৎ খাঁন বলেন, বর্ষা হোক আর শুষ্ক মৌসুম হোক, তিস্তার পানি ক্যানেলে ও মূলধারায় সমানভাবে প্রবাহের মাধ্যমে উভয় তীরের জনগোষ্ঠীকে সুফল ভোগের সুযোগ দেওয়া দরকার। সেইসঙ্গে তিস্তার নাব্যতা কমিয়ে পূর্ব তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলাবাসীকে বন্যা আর খরার মতো দুর্ভোগ থেকে রক্ষার দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবার্হী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সেচ প্রকল্পের আওতায় ৮০ হাজার হেক্টর জমি চাষাবাদের আওতায় আনার কথা থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানি না থাকায় গত বছর মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমির সেচ দেওয়া হয়েছে। নিয়মানুযায়ী বর্ষাকালে সেচ ক্যানেলে পানি না দিয়ে মূলধারায় দেওয়া হয়। তবে সরকার মনে করলে তিস্তার পানি উভয় তীরের জনগোষ্ঠী সমভাবে ভোগ করতে পারবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা পেলে এ ব্যারেজে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নানামুখী কাজে ব্যবহার করা যাবে তিস্তার পানি।