রসনার স্বাদ :
দিন দুয়েক আগে অপু গিয়েছিল এক অসুস্থ স্বজনকে দেখতে। ওই স্বজনকে কী খাওয়ানো যায় তাই ভাবছিল সে। বাজারে যে ফলমূল পাওয়া যায় তা তো অনেকটাই অনিরাপদ। এই ভেবে বাড়িতে লাগানো আধা-পাকা আমই সাথে নেয় অপু। আর কী নেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে পৌঁছল চৌধুরানী বাজারে। ইদের কেনাকাটা চলায় তিল ধারণের যেন ঠাঁই ছিল না সেখানে।
বাইকটি কোনোমতে দাঁড় করিয়ে রাখতেই তার নজর পড়লো চার মাথার ঠিক দক্ষিণ পাশে 'ভাই ভাই' নামক একটি কনফেকশনারির দিকে। দোকানটি ছিল গ্লাস লাগানো এবং বেশ পরিপাটি। ভাবে দোকানটি হয়তো ভালো মানের খাদ্যপণ্য বিক্রি করে। গ্লাসের ভিতর রক্ষিত দই ভালো কি না জিজ্ঞেস করলে দোকানি তাকে বলল, 'খুবই ভালো মানের দই। একেবারে বগুড়ার খাঁটি দই।'
একজন ক্রেতা হিসেবে বিক্রেতার কথার ওপর ভরসা রাখে সে। ভরসা না রেখে আর উপায়ই বা কী তার!
লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির এ যুগে দু'শ টাকার দইয়ের দাম মাত্র চল্লিশ টাকা বেশি চাইলেন বিক্রেতা। কী আর করার! দরকষাকষি না করে নিরবেই টাকাটা বিক্রেতার হাতে গুঁজে দিয়ে এক সরা দই নিয়ে গিন্নিসহ পৌঁছল ওই স্বজনের বাড়িতে। বেচারা অসুস্থ। তাই রসনার স্বাদ ও নাকের ঘ্রাণশক্তি কমে গেছে তার। আর সে কারণে হয়তো দইয়ের টক কিংবা উৎকট গন্ধটাও বুঝতে পারেন নি ওই অসুস্থ স্বজন। দইয়ের মানটা যে পুরোপুরি নষ্ট গেছে অনেক আগেই তা ওই স্বজনের সহধর্মিণীর কথায় বুঝতে আর বাকি রইলো না অপুর। পরখ করে দেখল উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ তো কোন ছাই! কোন প্রতিষ্ঠানের তৈরি সেটিও লেখা নেই দইয়ের গায়ে। গন্ধ শুকে নিশ্চিত হলো টক ও উৎকট গন্ধ বেরোনোর বিষয়টি। মনে মনে আফসোস করে বলল, 'বেঁধে দিন ঠিক যেমনটি ছিল।'
ফেরার পথে আবার দাঁড়াল সে সেই 'ভাই ভাই কনফেকশনারিতে।' উদ্দেশ্য ছিল দোকানি যে নষ্ট দই দিয়েছিলেন তা ফিরিয়ে দিতে।
দোকানে কয়েকজন ক্রেতা থাকায় দোকানটির সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে মন চাইলো না তার। তাই তো ফিসফিস করে দোকানির কানে কানে বলল, 'এটি একটু আড়ালে গিয়ে আপনি নিজে খেয়ে দেখুন তো মান ঠিক আছে কি না?'
এবার দোকানি কোনো কিছু না বলে তা নিয়ে চলে গেলেন আড়ালে। দু'জন কী যেন পরামর্শ করে মিনিট দুয়েক পরে ফিরে এনে বললেন, বলেন কী! আমরা তো খেয়ে দেখলাম মান একদম ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নেই।
বুঝতে আর বাকি রইলো না অপুর। মনে মনে ভাবলো, পণ্য খারাপ কিংবা নষ্ট যাই হোক তা ক্রেতা বা ভোক্তার সামনে বলবে না দোকানি। দায় চাপাবে ওই আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাঁধে। মুখে দেওয়া মাত্রই খাদ্যের স্বাদ ও গুণাগুণ বলে দেওয়া যে রসনার ধর্ম, সেই রসনা দোকানিরও আছে বটে কিন্তু মিথ্যাচার করলেন তিনি। পার্থক্য করলেন রসনার ধর্মেরও। ওই দইই ফেরত না নিয়ে আবার দিতে চাইলে তা আর নিতে চাইলো না অপু। ক্ষানিকটা সময় অপেক্ষা করলো দোকানি টাকা ফেরত দিবে ভেবে। কিন্তু দোকানি টাকা ফেরত না দিয়ে আরেকটা দই বেঁধে দিয়ে বললেন, 'এটি একদম খাঁটি।' কিংকর্তব্যবিমূঢ় অপু বাধ্য হয়েই দই নিয়ে বাড়ির দিকে যাত্রা করে সে।
এদিকে বাড়িতে রেখে গিয়েছিল অপু ও তার স্ত্রী দুই সন্তানকে। ফেরতে দেরি হওয়ায় ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছিল তারা। মাকে বাড়িতে পেয়েই ছেলেরা বায়না ধরলো কিছু খাবে বলে। মা সুচন্দা ওদের বললেন, তোর বাবা দই এনেছে। এসো দই খেতে দেই। বেশ আগ্রহ নিয়ে খেতে বসে দুই ভাই। সদ্য চিকিৎসা শাস্ত্রে পরীক্ষা শেষ করে আসা বড় ছেলে একটু মুখে দিয়ে সাথে সাথে বলল উঠল, 'ওয়াক থু।'
এম এ মাসুদ
কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী