নোয়াখালী ও কোম্পানীগঞ্জ প্রতিনিধি।। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও দৃশ্যত আবার তা শান্তও হয়েছিল। গতকাল শনিবার বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা মানববন্ধন কর্মসূচির ডাক দিয়ে তা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় স্বস্তি ফিরেছিল এলাকায়। তবে শুক্রবার সেখানে সংঘর্ষে আহত এক সাংবাদিক গতকাল শনিবার রাতে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তার নাম বোরহান উদ্দিন মোজাক্কের। এর আগে কাদের মির্জাকে দল থেকে বহিস্কার করার কথা বলা হলেও তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। এদিকে গতকাল কোম্পানীগঞ্জে কাদের মির্জার সমর্থকদের ওপর র্যাব ও পুলিশের হামলায় ৪০ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত এই মেয়র।
কাদের মির্জাকে গতকাল কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি দেয় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি তাকে দল থেকে বহিস্কারের জন্যও কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সুপারিশ করা হয় বলে জেলা আওয়ামী লীগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। তবে দুই ঘণ্টা পর আবার জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এএইচএম খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম সেই অব্যাহতি ও বহিস্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, তিনি বহিস্কারের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন।
গুলিবিদ্ধ সাংবাদিকের মৃত্যু :মেয়র কাদের মির্জা ও কোম্পানীগঞ্জের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ সাংবাদিক মোজাক্কের (২৫) গতকাল রাত পৌনে ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ সময় তার স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। শুক্রবার মধ্যরাতে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সাংবাদিক বোরহান দৈনিক বাংলা সমাচার ও বার্তা বাজার অনলাইন নিউজ পোর্টালের প্রতিনিধি। তিনি নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। তিনি কোম্পানীগঞ্জের চরপকিরা ইউনিয়নের নোয়াব আলীর ছেলে।
শুক্রবার কোম্পানীগঞ্জের চাপরাশিরহাটের পূর্ব বাজারে আওয়ামী লীগের দু'গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ওই সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে সাংবাদিক বোরহানসহ সাতজন গুলিবিদ্ধ হন। আহত সাংবাদিককে প্রথমে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল এবং পরে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই বাচ্চু মিয়া বলেন, ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে রাখা হয়েছে। মোজাক্কেরের মৃত্যুতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শোক প্রকাশ করেছেন।
পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, পুলিশের হামলা :সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই কাদের মির্জা দুই মাস ধরে 'সত্য বচনের' পর সর্বশেষ এক সপ্তাহ ধরে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসিকে প্রত্যাহারের দাবি তোলেন। একই সঙ্গে তিনি নোয়াখালী ও ফেনীর অপরাজনীতি বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ, অবস্থান ও হরতালের মতো নানা কর্মসূচি দিয়ে আসছেন।
দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আবদুল কাদের মির্জার বক্তব্যের প্রতিবাদে গত শুক্রবার কোম্পানীগঞ্জের চাপরাশিরহাট বাজারে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের মিছিলকে কেন্দ্র করে দু'পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে সাতজন গুলিবিদ্ধসহ আহত হন অন্তত ২৫ জন। এর প্রতিবাদে গতকাল শনিবার মির্জা কাদেরের ডাকে কোম্পানীগঞ্জে পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল। কাদের মির্জা ও মিজানুর রহমান বাদল গতকাল আবার পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
হরতালের সমর্থনে সকালে কাদের মির্জার সমর্থকরা বসুরহাট পৌর শহরের বিভিন্ন স্থানে মিছিল করেন। সকাল ৭টার দিকে তিনি মিছিল নিয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানার সামনে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় শুরু হয় হাতাহাতি। এক পর্যায়ে পুলিশ ও র্যাব লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে কাদের মির্জার ৪০ সমর্থক আহত হন বলে দাবি তার।
পরে বসুরহাটের রুপালি চত্বরে সংবাদ সম্মেলনে কাদের মির্জা বলেন, শুক্রবার বিকেলে তার নেতাকর্মীদের ওপর প্রশাসনের সহযোগিতায় সাবেক চেয়ারম্যান বাদল হামলা ও গুলি চালান। এতে তার অর্ধশতাধিক সমর্থক আহত হন। তিনি এসব ঘটনার বিচার দাবি করেন এবং আগামী সোমবার সকালে বসুরহাট পৌর শহরে মানববন্ধন কর্মসূচির ডাক দেন।
পরে শনিবার রাত ৯টার দিকে কাদের মির্জা ফেসবুক লাইভে এসে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। লাইভে তিনি বলেন, 'দল যে সিদ্ধান্ত দেবে, তার প্রতি আমি আস্থাশীল। রাজনীতি করি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের। রাজনীতি করি আওয়ামী লীগের। আমি শেখ হাসিনার রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। শেখ হাসিনা যখন যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেই সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নেব। নেত্রী যেহেতু বলেছেন, নোয়াখালীর বিষয়ে তিনি প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, সে জন্য আমি ইতোপূর্বে ঘোষিত সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করছি। আমি চাই নোয়াখালীতে ত্যাগী নেতারা যেন স্থান পান।' অন্যদিকে, কাদের মির্জা পুরো কোম্পানীগঞ্জকে জিম্মি করে রেখেছেন বলে অভিযোগ করেন বাদল। সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেন, কাদের মির্জা একের পর এক অপরাজনীতি করে যাচ্ছেন।
এদিকে আব্দুল কাদের মির্জার সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ছে পাশের জেলা ফেনী আওয়ামী লীগেও। কাদের মির্জার জন্য যারা দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও গত কয়েক দিন তিনি বক্তব্য দিচ্ছেন। ফলে ওইসব নেতাকর্মীও তার কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন। এ ছাড়া কাদের মির্জার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন নোয়াখালী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী, ফেনী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী, সোনাগাজীর উপজেলা চেয়ারম্যান ও ফেনী আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন, দাগনভূঞার উপজেলা চেয়ারম্যান ও ফেনী যুবলীগ সভাপতি দিদারুল কবির রতন, ফেনীর পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী, ছাগলনাইয়ার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল, ফুলগাজীর চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলিমসহ অনেক নেতা।
নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এএইচএম খায়রুল আনম সেলিম চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশ কে বলেন, মির্জা কাদের আওয়ামী লীগের কোনো বড় পদে নেই। উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য তিনি। তবে প্রত্যাহার ও বহিস্কারের সুপারিশ বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথমে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। পরে দলীয় শান্তি বজায় রাখতে আমি সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছি। তবে এ বিষয়ে লিখিত কিছু না দিয়ে তিনি বলেন, এটা আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আপাতত আমি পরিস্থিতি দেখতে চাচ্ছি। পুরো বিষয়টি কেন্দ্রের ওপর ছেড়ে দিতে চাচ্ছি।
এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশ কে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কাদের মির্জা ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে আসছেন। তাকে দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাকে বহিস্কার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির সিদ্ধান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, আগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের বিষয়টি তার ব্যক্তিগত। সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
কাদের মির্জার আধাঘণ্টা পর ফেসবুক লাইভে এসে নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, 'কাদের মির্জার অব্যাহতি বহাল রয়েছে। এ রকম লোককে দলে রাখা উচিত নয়। কাদের মির্জা শুধু নোয়াখালী নয়, সারাদেশের আওয়ামী লীগকে ছোট করেছেন। তাকে তো ছাড়া যায় না। তার বিরুদ্ধে আমরা অবস্থান নিয়েছি।' তবে কাদের মির্জা বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের কোনো কমিটি নেই। এদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এই অবৈধ কমিটির কোনো অস্তিত্ব নেই। এ কমিটি আমাকে বহিস্কার করার ক্ষমতা রাখে না।