আহনাফ আদিব,ঢাকা:: গত ৩১ মে সরকারি এক হাসপাতালের পরিচালক এই প্রতিবেদককে দেখিয়েছিলেন, তার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের নাম-ঠিকানা সব সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বার্তা দিয়ে জানাচ্ছেন। আর সেটা করা হচ্ছে রোগী বেশি কোন এলাকার, সেটা নির্ধারণের জন্য। কিন্তু সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়নি সিটি করপোরেশন।
হাসপাতালে ভর্তি রোগীর বিষয়ে দুঃখ করে তিনি বলছিলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো চিকিৎসা দিচ্ছি, কিন্তু মশা তো আমরা মারতে পারি না। অথচ সিটি করপোরেশনকে সব তথ্য দেয়ার পরও তারা কাজ করছে না। অথচ এভাবে রোগী বাড়তে থাকলে পুরো হাসপাতালেও জায়গা থাকবে না।’
জুন-জুলাই পার হয়ে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে এসে সেই পরিচালকের কথা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তব রূপ নিচ্ছে। কেবল সরকারি হাসপাতলের সেই পরিচালকই নন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একাধিকবার রোগী বাড়ছে বলে সতর্ক করেছে। মশা নির্মূল অথবা নিয়ন্ত্রণের জন্য সংশ্লিষ্টদের সতর্কবার্তা দিয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের সেই সতর্কবার্তা আমলে নেয়া হয়নি, দেয়া হয়নি গুরুত্ব, নেয়া হয়নি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে শূন্য হচ্ছে মায়ের বুক, সন্তানের আহাজারি মাকে হারিয়ে। হাসপাতালের একটা শয্যা আর আইসিইউ পাওয়ার জন্য একের পর এক ফোন আসছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। অসহায় কণ্ঠে তারা বলছেন, যাদের গাফিলতির কারণে আজ এ অবস্থা, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। কারও যেন কোনো দায় নেই এ দেশে। অথচ নিয়ন্ত্রণ করা যায়- এমন এক মশার কামড়ে মানুষ মরে যাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছিলেন, আগস্ট হতে যাচ্ছে ভয়ংকর। আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে রোগী ভর্তি হওয়ার নতুন রেকর্ড হয়েছে দেশে। ঠিক সেদিনই খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শঙ্কা জানিয়ে বলছে, চলতি মাসেই (আগস্ট) রেকর্ডসংখ্যক ডেঙ্গু শনাক্ত হতে পারে। আগস্ট মাসে এসেও ডেঙ্গু সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে, যা দেশে ডেঙ্গুর অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করতে পারে।
গত ৭ আগস্ট ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক শঙ্কা জানিয়ে বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি বাড়তে যাচ্ছে। জুলাই মাসে দেশে ৪৫ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, অথচ ২০২২ সালের জুলাইয়ে রোগী ছিল ১ হাজার ৫০০ জন।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহাদাৎ হোসেন ডেঙ্গু নিয়ে নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, জুন মাসের তুলনায় দেশে জুলাইয়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার অনেক বেশি ছিল। এমনকি আগস্ট মাসে এসেও ডেঙ্গু সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে, যা দেশে ডেঙ্গুর অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করতে পারে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের যে পরিস্থিতি, যেহেতু ঢাকার বাইরে রোগী বাড়ছে, সেহেতু আগস্ট মাসে এ হারে যদি সংক্রমণ বাড়ে এবং যদি স্থিতিশীলতা না আসে, তাহলে এ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার অন্যান্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি হতে পারে।
অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আগস্ট মাসের প্রথম ৮ দিনেই ২০ হাজার ৩৯৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, যেখানে জুলাই মাসে ছিল ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল বুধবার জানিয়েছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ৮৪৪ জন, যা চলতি বছরে এক দিনে সর্বোচ্চ রোগী।
অধ্যাপক ডা. শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ঢাকা সিটিতে ডেঙ্গু সংক্রমণ স্থিতিশীল থাকলেও ঢাকার বাইরে আক্রান্তের হার এখনো বাড়ছে। তার কথার সত্যতা মেলে অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে। ৯ আগস্টের তথ্যে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যে ২ হাজার ৮৪৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৯২ জন আর সিটি করপোরেশনের বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৭৫২ জন।
৯ আগস্টে আরও ১২ জনের মৃত্যুর কথা জানায় অধিদপ্তর। তাদের নিয়ে চলতি বছরে ৩৫২ জনের মৃত্যুর কথা জানাল অধিদপ্তর। এর আগে গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়। ওই বছরে ২৮১ জনের মৃত্যুর কথা জানায় অধিদপ্তর। কিন্তু চলতি বছরের ৩ আগস্ট সে রেকর্ড ভেঙে যায়।
মূলত ১ থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন ২ অঙ্কের মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। আর কেবল ৪ আগস্ট ছাড়া প্রতিদিন ২ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সরকারি হিসাবেই চলতি বছরের ৭ মাস ৯ দিনে রোগীর সংখ্যা হয়েছে ৭৫ হাজার ৬৯ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা যায়, গত ৭ জুলাইতে রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়ায়। তারপর থেকেই রোগী বাড়তে থাকে জ্যামিতিক হারে। ২৪ জুলাইতে রোগী ছাড়িয়ে যায় ৩৫ হাজার, ২৬ জুলাই ছাড়ায় ৪০ হাজার, ৩১ জুলাইতে ছাড়িয়ে যায় ৫১ হাজার। আর ৯ আগস্ট পর্যন্ত রোগী সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৭৫ হাজার। অর্থাৎ ৯ দিনে ২৩ হাজার ২৩৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
চলতি বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বর্তমান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, গত বছর ডেঙ্গুর পিক ছিল অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। এবারও তাই হচ্ছে। তিনি বলেন, যে অবস্থা চলছে, তাতে বলা যায় এই ধারা চলবে আরও কয়েক মাস। গত বছর শীতের সময়েও রোগী পাওয়া গেছে, ভর্তি রোগীর সংখ্যায় ২০১৯ সালকে ছাড়িয়ে যাওয়া যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।