স্টাফ রিপোর্টার:: নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে ভোটে অংশগ্রহণের জন্য নতুন নতুন ছক কষতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচনে অংশ নিতে এরইমধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি একদফা দিয়েছে। বিএনপি চায় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চায় প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে সাংবিধানিক ধারায় নির্বাচন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি মাথায় রেখেই ভোটের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি প্রচারে প্রাধান্য পাচ্ছে উন্নয়ন।
আসন্ন ভোটের আগেই সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেই যোগাযোগ অবকাঠামোর দুই হালি প্রকল্প উদ্বোধন করবে সরকার। নির্বাচনের আগে উন্নয়নের চমক ভোটের রাজনীতিতে ইতিবাচক সাড়া ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
উদ্বোধনের অপেক্ষায় যেসব প্রকল্প: ১. খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্প, ২. পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প, ৩. কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্প, ৪. আখাউড়া-আগরতলা আন্তঃদেশীয় রেল সংযোগ প্রকল্প ৫. মেট্রোরেল প্রকল্প, ৬. পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে ৭. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্যানেল ৮. শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনাল।
আগারগাঁও-মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রথম মেট্রোরেল আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশের উদ্বোধন করবেন আগামী ২০ অক্টোবর। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ তথ্য জানান।
ওইদিন প্রধানমন্ত্রী মেট্রোরেলের ফার্মগেট, সচিবালয় ও মতিঝিল স্টেশন উদ্বোধন করবেন। এ ছাড়া ঢাকা মেট্রোরেলের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশে ৭টি স্টেশন রয়েছে। এগুলো হলো-বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, টিএসসি, প্রেস ক্লাব ও মতিঝিল।
মেট্রোরেলের আগারগাঁও-মতিঝিল অংশটি চালু হলে যাত্রীরা উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মাত্র ৩৮ মিনিটে যাতায়াত করতে পারবেন। যা ঢাকার জীবনযাত্রায় একটি অলৌকিক ঘটনা। প্রাথমিকভাবে প্রতি ১৫ মিনিটে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পাঁচটি ট্রেন চলবে এবং সময়ের ব্যবধান কমিয়ে ধীরে ধীরে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হবে বলে জানান মন্ত্রী।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক বলেন, ফার্মগেট, সচিবালয় ও মতিঝিল স্টেশনগুলো ২০ অক্টোবর চালু হচ্ছে। স্টেশনের যাবতীয় কাজ শেষ হয়েছে। এখন স্টেশনে যাত্রীবাহী ওয়াকওয়ের কাজ চলছে এবং ১৫ অক্টোবরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন সিদ্দিক। প্রাথমিকভাবে সব ট্রেন মতিঝিল পর্যন্ত যাবে না। ট্রেনের নম্বর দেয়া থাকবে। নম্বর অনুযায়ী কোন ট্রেন আগারগাঁও যাবে আর কোনটি মতিঝিল যাবে, তা শনাক্ত করা যাবে।
ডিএমটিসিএল এমডির মতে, একটি ট্রেন বাণিজ্যিকভাবে চলার আগে লাইনে তিন ধাপের পরীক্ষা চালানো হয়। ট্রায়াল রানের প্রথম ধাপ হলো দক্ষতা পরীক্ষা বা কর্মক্ষমতা পরীক্ষা। দ্বিতীয় ধাপে হবে সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন টেস্ট। চূড়ান্ত পর্যায়ে হবে ট্রায়াল রান বা পরীক্ষামূলক আন্দোলন।
সিদ্দিকী আরো বলেন, এখন আমরা দ্বিতীয় ধাপে আছি এবং উদ্বোধনের পাঁচ দিন আগে সব পরীক্ষা শেষ হবে। মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষের মতে, পুরো সিস্টেমটি চালু হলে প্রাথমিকভাবে সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পরিষেবা পাওয়া যাবে এবং তারপরে এটি রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বাড়ানো হবে।
দেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। উল্লেখযোগ্যভাবে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) প্রকল্পটি সমর্থন করার জন্য ঋণ আকারে ১৯ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা প্রদান করে এবং অবশিষ্ট অর্থ বাংলাদেশ সরকার প্রদান করে।
২০১৭ সালে প্রকল্পের মূল নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটি ডিসেম্বর ২০২৫ এর মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকা মেট্রোরেলের এমআরটি-৬ লাইনের উত্তরা-আগারগাঁও সেকশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রথমে এই রুটের মাত্র ৩টি স্টেশন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। পরে উত্তরা-আগারগাঁও রুটের ৯টি স্টেশন পর্যায়ক্রমে চালু হয়।
বঙ্গবন্ধু টানেল:
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেলের উদ্বোধন করা হবে ২৮ অক্টোবর। তবে টানেলের ভেতরে যান চলাচল সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে পরদিন।
সেতুসচিব মো. মনজুর হোসেন জানান, ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেল উদ্বোধন করার পর আনোয়ারা প্রান্তে সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেবেন।
দেশের প্রথম টানেলের নামকরণ করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে চীনের চায়না কমিউনিকেশনস, কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসিএল) লিমিটেড।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি সাড়ে ৯৮ শতাংশ। ইতিমধ্যে টানেলের পূর্তকাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক (ইলেকট্রো মেকানিক্যাল) কাজ চলছে। টানেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। নগরের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উপজেলা প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়ক রয়েছে। এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে:
বাংলাদেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করতে যাচ্ছে পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে। এ এক্সপ্রেসওয়ে হতে যাচ্ছে আধুনিক ঢাকার নতুন গেইটওয়ে। দেশের প্রথম ১৪ লেনের মহাসড়ক, যার ৮টি এক্সপ্রেসওয়ে। নান্দনিক এ সড়ক ধরেই তৈরি হচ্ছে পূর্বাচল স্যাটেলাইট সিটির নকশা। মহাসড়কের দুপাশে রয়েছে ১০০ ফিট খাল। সাড়ে ১২ কিলোমিটার এ সড়কে থাকবে পাঁচটি অ্যাডগ্রেড ইন্টারসেকশন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীনে নির্মিত এ সড়কপথে শেষ সময়ে চলছে লাইটপোস্ট আর রোড মার্কিংয়ের কাজ। রাজধানীর বুকে এ ১২ দশমিক ৩ শূন্য কিলোমিটার দীর্ঘ ১২ লেনের এই এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে নতুন শহর পূর্বাচলের সঙ্গে যুক্ত হবে নগরীর বাকি অংশ। একই সঙ্গে যানজট কমিয়ে ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরি করবে। এ প্রকল্পের কাজ শেষ, অপেক্ষা কেবল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক উদ্বোধনের জন্যে। চলতি বছরের অক্টোবরের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল:
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল আগামী ৭ অক্টোবরে চালু হতে যাচ্ছে। দৃষ্টিনন্দন টার্মিনাল ভবনও এখন দৃশ্যমান। চলছে অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার কাজ। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন টার্মিনালটি পুরোপুরি চালু হলে বাড়বে উড়োজাহাজ চলাচল ও যাত্রীসেবার মান। জানতে চাইলে বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, নির্মাণাধীন এ টার্মিনালের ফিচারগুলো অত্যন্ত অত্যাধুনিক। টার্মিনালটি যখন যাত্রীদের জন্য খুলে দেয়া হবে, এর ডিজাইন এবং সেবা দেখে তাদের মন আনন্দে ভরে উঠবে। তিনি আরো বলেন, নতুন এ টার্মিনাল নির্মাণ হলে যাত্রীসেবা দেয়ার ধারণক্ষমতা প্রতি বছর ১৬ মিলিয়নে পৌঁছাবে। আর আমরা যদি আগের টার্মিনালটা ধরি তাহলে ধারণক্ষমতা পৌঁছাবে ২৪ মিলিয়নে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প:
আগামী ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে রেল চলাচল শুরু হবে। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন এই রেলপথের উদ্বোধন করবেন।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এ বিষয়ে বলেন, পদ্মা সেতু হয়ে রেলপথ উদ্বোধনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সময় দিয়েছেন। ওই দিন একটি সুধী সমাবেশও হবে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত প্রায় ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ নির্মাণ করছে রেলওয়ে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮২ কিলোমিটার রেলপথ চালু হচ্ছে। আগামী বছর জুনে যশোর পর্যন্ত রেল চালুর লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার।
প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের এক সপ্তাহ পর থেকে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হতে পারে। শুরুতে একটি ট্রেন পরিচালনা করা হবে। প্রকল্প কার্যালয় থেকে ঢাকা-পদ্মা সেতু-রাজবাড়ী রুটে ট্রেন চালানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে রাজশাহী থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটি ট্রেন চালানোর প্রস্তাব রয়েছে। মধুমতি এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভাঙ্গা পর্যন্ত আসে। এই ট্রেন ঢাকা পর্যন্ত আনা হতে পারে। পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্পের অধীনে চীন থেকে ১০০ নতুন কোচও কেনা হয়েছে। নতুন কোচ দিয়েই ট্রেন চালু করা হবে।
রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উদ্বোধনের সময় সব স্টেশন এবং পুরো সংকেতব্যবস্থা হয়তো চালু করা যাবে না। শুরুতে তিনটি স্টেশনে ট্রেন থামার ব্যবস্থা থাকবে। স্টেশনগুলো হচ্ছে মাওয়া, পদ্মা (জাজিরা) ও শিবচর। মুন্সিগঞ্জের নিমতলা স্টেশনটিও চালুর চেষ্টা চলছে।
প্রকল্পের অগ্রগতিসংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুসারে, আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৮২ শতাংশ। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ৩ মে অনুমোদন করা হয়। সে সময় এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ২২ মে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। ব্যয় আরও বাড়তে পারে বলে রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এই রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে চীনের অর্থায়নে, জিটুজি (সরকারের সঙ্গে সরকারের) ভিত্তিতে। প্রকল্পের কাজ করছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ (সিআরইসি)। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে ২৬৬ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। বাকি অর্থ ব্যয় করছে বাংলাদেশ সরকার।
খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্প:
আগামী অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে চালু হতে যাচ্ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৌবন্দর মোংলার সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ। ইতোমধ্যে এই রেলপথের কাজ ৯৮ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে খুঁটিনাটি কাজ; যা চলতি মাসেই শেষ হওয়ার আশা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তারা জানিয়েছেন- মোংলা-খুলনা রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরু হলে মোংলা বন্দরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। কারণ শুধু সারাদেশের সঙ্গে নয়, রেলপথটি আন্তর্জাতিক রেল রুট হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এর মধ্য দিয়ে বন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল হবে।
মোংলা-খুলনা রেলপথের ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে জানিয়ে প্রকল্পের পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, ‘চলতি মাসে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। সেইসঙ্গে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে এই পথ দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হবে বলে আশা করছি। সেভাবে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি আমরা।’
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ট্রানজিট সুবিধার আওতায় ভারত, নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন সহজ করতে খুলনার ফুলতলা রেলস্টেশন থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এই রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হয়। প্রথম দফায় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা।
প্রকল্পের কাজ তিন ভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে রয়েছে রূপসা নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণ, মূল রেললাইন স্থাপন এবং টেলিকমিউনিকেশন ও সিগন্যালিং স্থাপন।
২০১১ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ করতে পারেননি ঠিকাদার। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকা।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, তা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় দফায় সংশোধনের পর ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। সেইসঙ্গে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লারসেন অ্যান্ড টুব্রো রূপসা নদীর উপর রেলসেতুর নির্মাণকাজ করেছে। বাকি কাজ করেছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনাল।
এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক আরিফুজ্জামান বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি ও নানা কারণে কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে। দুই দফায় প্রকল্প সংশোধনের কারণে ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। তবে তৃতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও ব্যয় বাড়েনি। আশা করছি, এবার নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে।’
মোংলা-খুলনা রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরু হলে ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল হবে জানিয়ে মোংলা বন্দরের ব্যবসায়ী মোস্তাক আহমেদ মিঠু বলেন, ‘বর্তমান সরকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগের জন্য যেমন পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে, তেমনি নিরবচ্ছিন্ন রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে মোংলা বন্দরের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন করেছে। এতে গার্মেন্টস পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য কম খরচে মোংলা বন্দর থেকে পরিবহন করা যাবে, তেমনি রফতানিও করা যাবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি বেড়ে যাবে।’
একই কথা বলেছেন বাগেরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার। তিনি বলেন, ‘রেললাইনটি ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে পণ্য পরিবহনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে চিংড়ি ও গার্মেন্টস পণ্য পরিবহন সহজ হবে।’
আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ:
আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলপথের কাজ শেষে পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চললো। বহুল কাক্সিক্ষত এই রেলপথ প্রকল্প বাংলাদেশের আখাউড়াকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্ব) প্রধান প্রকৌশলী ও আখাউড়া-আগরতলা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক আবু জাফর মিঞার নেতৃত্বে এ রেলপথে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলক বা ট্রায়াল ট্রেন চালানো হয়েছে (আখাউড়া) গঙ্গাসাগর থেকে ভারতীয় বর্ডার শিবনগর (শূন্য রেখা) পর্যন্ত।
শীঘ্রই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই রেলপথের উদ্বোধন করবেন বলে প্রকল্প পরিচালকের কাছ থেকে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আখাউড়া থেকে আগরতলার নিশ্চিন্তপুর পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণের জন্য ২০১৮ সালের ২১ মে ভারতের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেঙমেকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই প্রকল্পের কাজ শুরু করে। দুই দেশের এ রেলপথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ২৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে ৬ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার।
এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হয়েছে ৪৭৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এরমধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৫৭ কোটি ৫ লাখ টাকা এবং ভারতীয় ঋণ ৪২০ কোটি ৭৬ লাখ কোটি টাকা।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প:
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেললাইন এখন ট্রেন চলাচলের জন্য প্রস্তুত। আগামী ১৫ অক্টোবর নাগাদ এই রুটে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলবে। ওই মাসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই রেলপথ উদ্বোধন করবেন বলে রেলসূত্র নিশ্চিত করেছে।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, চট্টগ্রামের দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন করে ১০২ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনের কাজ বর্তমানে প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পের নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এখন ট্রেন চলাচলের জন্য প্রস্তুত এই রেললাইন।
তিনি বলেন, অক্টোবরের মাঝামাঝি অর্থাৎ আগামী ১৫ই অক্টোবর নাগাদ ( টেনটেটিভ) দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানোর জন্য প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। একটি ইঞ্জিন এবং ছয়টি বগি নিয়ে ট্রেনটি দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত যাবে। আর অক্টোরের শেষ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই রেলপথ উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। পরে ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে। প্রকল্পের আওতায় দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন করে ১০২ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ রেলপথ তৈরি করা হয়েছে।
পিডি জানায়, প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারে ঝিনুকের আদলে বিশ্বমানের সর্বাধুনিক রেলওয়ে স্টেশনের নির্মাণের পাশাপাশি দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মোট ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া, সংরক্ষিত বন এলাকায় রেললাইন স্থাপনে বন্য হাতি ও বন্যপ্রাণী চলাচলের জন্য ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। সম্প্রতি অতিবৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া ৪৫০ মিটার রেলপথ পুনঃসংস্কার শেষ হয়েছে। অতিসত্ত্বর এ রুটটির কাজ শতভাগ শেষ হবে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমান সরকারের নানা সমালোচনা থাকলেও একই সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় উন্নয়ন তো হয়েছেই। তা তো অস্বীকার করা যায় না। এসব প্রকল্পের নির্বাচনি সুবিধাও নিতে চাইবে আওয়ামী লীগ।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ জনকল্যাণমুখী রাজনীতি করে। বাংলাদেশের সব সোনালি অর্জন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই অর্জিত হয়েছে। শুধু কাঠামোগত উন্নয়ন নয়, নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়নেও কাজ করছে সরকার। আমরা আশা করি, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনেও উন্নয়নের পক্ষে-আওয়ামী লীগ সরকারে উপর পুনরায় ভরসা রাখবে দেশের জনগণ।