তাহমিনা আক্তার,ঢাকা:: সরকার পতনে জোরালো কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে দলের ভেতরে কঠোর হচ্ছে বিএনপি। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যারা লড়াই করতে পারবে তাদের নেতৃত্বের অগ্রভাগে নিয়ে আসা হচ্ছে।
নিষ্ক্রিয় পদধারীদের কৌশলে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে সাজানো হচ্ছে তিন স্তরের নেতৃত্ব। হঠাৎ এমন রদবদলের সূত্রপাত ২৯ জুলাইয়ের ঘটনার পর। ঢাকার চার প্রবেশমুখে ওইদিনের কর্মসূচি নিয়ে দলের ভেতরে মূল্যায়ন সমালোচনা ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে পদ হারানোর আতঙ্ক বিরাজ করছে কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয় থাকা নেতাদের মধ্যে।
অন্যদিকে সক্রিয়রা সরাসরি চলে আসছেন নেতৃত্বের অগ্রভাগে। একটি কর্মসূচি দেখে দলে এমন মূল্যায়ন নিয়ে প্রকাশ্যে কথা না বললেও নাখোশ অনেকে। তারা ওইদিনের কর্মসূচি শতভাগ সফল না হওয়ার পেছনে নেতাকর্মীদের টানা ক্লান্তি আর সমন্বয়হীনতাকে দুষছেন।
সূত্র জানায়, বিএনপি সেপ্টেম্বর থেকে অবস্থান কিংবা ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামবে। সেটিই হবে আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপ। তা সফল করতে সাহসী ও তরুণদের সামনে আনা হচ্ছে। গত ২৯ জুলাই অবস্থান কর্মসূচিতে নেতাদের ভূমিকা নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। দায়িত্বে অবহেলা ও নিষ্ক্রিয় নেতাদের তালিকা করা হচ্ছে। সেটি ওয়ার্ড থেকে শুরু করে থানা পর্যায় পর্যন্ত চলছে।
প্রথমে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হচ্ছে। নোটিসের জবাব যৌক্তিক না হলে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। আর কয়েকজনকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হচ্ছে। কোনো কোনো থানার আহ্বায়ক কমিটিও ভেঙে দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে অঙ্গসংগঠনে আসছে নতুন নেতৃত্ব। দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করতে পারলে নেতৃত্ব ছাড়ার কথা বলেছেন দলের হাইকমান্ড।
গত ২৯ জুলাই চারটি প্রবেশমুখে নেতাদের আগে থেকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির দায়িত্ব ছিল রাজধানীর উত্তরা বিএনএস সেন্টারের উল্টো দিকে। যেখানে প্রধান অতিথি থাকার কথা ছিল বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য আবদুল মঈন খান। এ ছাড়া দায়িত্ব ছিল ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিএনপির মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল, সদ্য সরিয়ে দেওয়া ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণের। আরেক প্রবেশমুখ গাবতলী এসএ খালেক বাসস্ট্যান্ডের সামনে প্রধান অতিথি থাকার কথা ছিল স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের। এখানে আরও দায়িত্ব ছিল ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানসহ সিনিয়র নেতাদের। রাজধানীর ধোলাইখালে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। এ ছাড়াও দায়িত্ব ছিল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, ঢাকা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বিএনপি মেয়রপ্রার্থী প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনের। আর রাজধানীর মাতুয়াইলে প্রধান অতিথি থাকার কথা ছিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের। এ ছাড়া দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম, বিএনপির বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদ, দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনসহ অঙ্গসংগঠনের নেতারা দায়িত্ব পালনের কথা ছিল।
এদের মধ্যে কয়েকজন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। আবার অনেকে সাহসী ভূমিকার জন্য প্রশংসিত হচ্ছেন। ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির এক যুগ্ম আহ্বায়ক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২৯ তারিখের রেশ এখনও সংগঠনে কাটেনি। সবাই রীতিমতো আতঙ্কে আছে কখন কার পদ যে যায় বলা মুশকিল। দেখুন ২৮ জুলাইয়ের মহাসমাবেশে নেতাকর্মীদের ভূমিকায় ফুলের মালা দেওয়ার মতো প্রশংসা করা হলো, ঠিক পরদিনের ভূমিকার জন্য কাঁটার মালা দেওয়া হচ্ছে। এক দিনে কি আমাদের সব অর্জন ভেস্তে গেল? এসব সিদ্ধান্ত একসময় আত্মঘাতী হয়ে উঠবে।
তিনি জানান, ২৯ তারিখ কর্মসূচিতে যারা সক্রিয় ছিলেন তাদের অনেককে সরাসরি যুগ্ম আহ্বায়ক করা হচ্ছে। যিনি এত বড় পদ পাওয়ার যোগ্য নন। শুধু একটি অবদানের জন্য এত বড় পুরস্কার পাচ্ছেন। আবার যারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উত্তর বিএনপির একজন সদস্য বলেন, ২৮ জুলাই ঢাকায় যে আবহ তৈরি হয়েছিল, পরের দিন তা ধরে রাখা যায়নি। ওইদিনের জনস্রোত দেখে আওয়ামী লীগসহ পুলিশ প্রশাসন ভয় পেয়েছিল। কিন্তু ঠিক পরের দিনের কর্মসূচিতে তার উল্টোটা হয়েছে। এর পেছনে কিছু সমন্বয়হীনতা আর ক্লান্তিকে দোষারোপ করতে হবে। হ্যাঁ, এটা ঠিক ওইদিন হাজার হাজার লোকের সমাগম হলে পুলিশ এভাবে আক্রমণাত্মক হতে পারত না।
২৯ জুলাইয়ের কর্মসূচিতে গাফিলতির অভিযোগে ইতিমধ্যে ছাত্রদলের সভাপতি পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণকে। বাতিল করা হয়েছে যুবদলের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটি। দেওয়া হয়েছে নতুন কমিটি। ঢাকা মহানগর উত্তরের নতুন কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে শরীফ উদ্দিন জুয়েলকে। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, নতুন কমিটি পাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমাদের শুভেচ্ছ বিনিময় হয়েছে। নেতাকর্মীরা আরও উজ্জীবিত হয়েছেন। আন্দোলনে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত সবাই। আমাদের লক্ষ্য এখন কর্মসূচিতে লোকজন বাড়ানো।
সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তরের কমিটিতেও ব্যাপক রদবদল আসতে পারে। নেতৃত্বের সামনে আসতে পারেন-এমন কয়েকজনের নামও শোনা যাচ্ছে। সাবেক ছাত্রনেতা আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল ও হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণদের নাম আসছে। একই সঙ্গে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলেও বড় পদের পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
যদিও ভেতরের এসব ঘটনাকে সাংগঠনিক কর্মপরিকল্পনার অংশ বলছেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক। তিনি বলেন, আন্দোলনের বিভিন্ন ধাপ আছে। যে ধাপে যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তাই করছে বিএনপি। আন্দোলন জোরালো করতে হলে সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। আমাদের মনোযোগ সরকার পতন আন্দোলনে কীভাবে আরও কঠোর ভূমিকা রাখা যায়। তিনি বলেন, আমাদের থানায় আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া আছে। কৌশলগত কারণে তা পূর্ণাঙ্গ করা নিয়ে ভাবছি না। আমরা পরিকল্পনা সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত করা।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, এগুলো দলের স্বাভাবিক সাংগঠনিক প্রক্রিয়া। কাজ করতে গেলে বোঝা যায় কোথায় ঘাটতি আছে। সামনে যব ঘাটতি পূরণ করা হবে।