আশরাফুল হক, লালমনিরহাট | লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে গণপিটুনি দিয়ে আবু ইউনুস মো. সাহিদুন্নবী জুয়েলকে হত্যার পর মরদেহ পোড়ানোর ঘটনায় হাফিজুল ইসলাম নামে এক ইউপি সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৮ জন গ্রেফতার ও ১২ জন স্বেচ্ছায় আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) দিনগত মধ্যরাতে বুড়িমারী বাজার থেকে ইউপি সদস্য হাফিজুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের এক নম্বর ওয়ার্ড সদস্য। জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক বলেন, আবু ইউনুস মো. সাহিদুন্নবী জুয়েল হত্যায় দায়ের করা হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা ও বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনে হামলার মামলায় এজাহার নামীয় আসামি ইউপি সদস্য হাফিজুল ইসলাম দীর্ঘ দিন পলাতক থেকে শুধুমাত্র হত্যা মামলায় মহামান্য হাইকোর্টে চার সপ্তাহের জামিনে রয়েছেন। কিন্তু পুলিশের উপর হামলার মামলায় ১৪ নম্বর আসামি হিসেবে বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) দিনগত মধ্যরাতে বুড়িমারী বাজার থেকে হাফিজুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জুয়েল হত্যার ঘটনায় দায়ের করা তিন মামলায় পুলিশ এখন পর্যন্ত ৪৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। এছাড়াও স্বেচ্ছায় আদালতে আত্নসমার্পন করেছেন ১২ জন আসামি। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ১৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। যার মধ্যে মূলহোতা বুড়িমারী ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি আবুল হোসেন ওরফে হোসেন ডেকোরেটর এবং মসজিদের খাদেম জোবেদ আলীসহ ছয় জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই মামলায় গ্রেফতারদের মধ্যে হত্যা মামলায় মুয়াজ্জিন ও অন্য দুই মামলায় মোট ১৮ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বলেও নিশ্চিত করেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক।
জানা যায়, গত ২৯ অক্টোবর বিকেলে পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক সাহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক ছাত্র ছিলেন। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, সাহিদুন্নবী জুয়েল ২৯ অক্টোবর বিকেলে সুলতান রুবায়াত সুমন নামে এক জনকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িমারী বেড়াতে আসেন। বিকেলে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন তারা। নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের সানসেটে রাখা কোরআন শরিফ নামাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কয়েকটি কোরআন শরীফ ও হাদিসের বই তার পায়ে ওপর পড়ে যায়। সে সময় কোরআন শরীফ ও হাদিসের বই তুলে চুম্বনও করেন জুয়েল। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে মুয়াজ্জিনের কথা কাটাকাটি হয়। এরপর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত জুয়েল ও সুলতান রুবায়াত সুমনকে পাশে ইউপি ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখেন। খবর পেয়ে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও ওসি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে যান। সন্ধ্যায় পুরো বাজারে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, কোরআন অবমাননার দায়ে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে। সে সময় উত্তেজিত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ইউপি ভবনের দরজা-জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে মরদেহ টেনে-হিঁচড়ে পাটগ্রাম বুড়িমারী মহাসড়কে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে। সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধা থানা পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতার ছোড়া ইট-পাথরের আঘাতে পাটগ্রাম থানার ওসি সুমন্ত কুমার মোহন্তসহ ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ১৭ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। রাত সাড়ে ১০টার দিকে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবু জাফর ও পুলিশ সুপার (এসপি) আবিদা সুলতানা অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। নিহত জুয়েলের সঙ্গী সুলতান রুবায়াত সুমনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।
ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত ৩০ অক্টোবর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টিএমএ মমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত জুয়েলের চাচাত ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনাস্থলের ভিডিও দেখে আসামি শনাক্ত করে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৮ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার সবাই বুড়িমারী এলাকার বাসিন্দা বলে জানায় পুলিশ।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার কোনো সত্যতা পায়নি। গুজব ছড়িয়ে জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা ও পরে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন দু’টি তদন্ত কমিটির সদস্যরা।