আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। প্রত্যেক পিতা মাতা চায় তাঁর গর্ভে আসা সন্তানটি যেন মহান সৃষ্টি কর্তার অসীম কৃপায় সুস্থতা নিয়ে যেন পৃথিবীর আলো দেখতে পায়।ভ্রূণ অবস্থা থেকে পৃথিবীতে আসা পর্যন্ত শিশুর মা প্রায়সই চিন্তিত থাকেন তাঁর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গ যেন সুস্থ থাকে। পিতামাতা সর্বদা কায়মনোবাক্যে মহান সৃষ্টি কর্তার নিকট দোয়া করে যে, আল্লাহ কিছুই চাইনা, তুমি শুধু আমাদের সন্তানটিকে সুস্থ ও সবলভাবে পৃথিবীতে পাঠাও।এজন্য মা সার্বক্ষণিক ভালো চিন্তা করেন,মহামানবদের জীবনী পড়েন, সৃষ্টি কর্তার আনুগত্য প্রকাশের বিভিন্ন কাজ গুলো মনোযোগ দিয়ে করতে থাকেন। কারণ জানেন বা শুনেছেন শিশু গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন কোরআন,হাদিস বা ধর্মীয় গ্রন্থ পড়লে, বিভিন্ন মনীষীদের জীবনী পড়লে, নবী রাসুল সাঃ দের জীবনী পড়লে, সত চিন্তা করলে তথা প্রতিটি কাজে মনে প্রাণে সৃষ্টি কর্তাকে স্মরণ করা বা আনুগত্য প্রকাশ করলে আগত সন্তানটি সুস্থ হবে এবং তার মন,মগজ,আচরণ, কথাবার্তা, চলাফেরা, লেনদেন,ব্যবহার, কাজকর্ম ইত্যাদি ভাল হবে।সেই বুকভরা আশা নিয়ে মানুষ চলছে।
কিন্তু সৃষ্টির কি রহস্য একমাত্র সৃষ্টি কর্তাই জানেন।এতো কিছর পরেও শিশু জন্ম গ্রহণ করার পর দেখা যায় যে,তাঁর চোখ আছে দেখা না,কান আছে শোনে না, পা আছে হাটতে পারে না,হাত আছে ঠিকমত কিছু ধরতে পারে না, মুখ আছে ঠিকমত কথা বলতে পারে না। অর্থাৎ তার শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। এরকম অবস্থায় পিতা মাতা পরে যায় মহা বিপদে।এতো কষ্ট করে দুনিয়ায় আসার পর তাকে শান্তিতে রাখার জন্য প্রাণপন চেষ্টা অব্যাহত রাখেন।
এরকম শিশুদের সাধারণত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বা প্রতিবন্ধী শিশু বলা হয়ে থাকে।বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বা প্রতিবন্ধী শিশু বলতে আমরা সাধারণত যে শিশুর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রসঙ্গের মধ্যে কোন অঙ্গের অক্ষমতা,বৈকল্য বা স্বাভাবিক না থাকায় সেই অঙ্গের জন্য নির্ধারিত কাজ সে করতে বা প্রকাশ করতে পারেনা বা বিশেষ কোন চাহিদা রয়েছে যা সাপোর্ট প্রয়োজন।যার মাধ্যমে সে কিছুটা হলেও সহায়তা পেয়ে কাজটি করতে চেষ্টা করতে পারবে।প্রতিবন্ধীতার কারণে একজন শিশুর জন্য নিদিষ্ট ক্রিয়াকলাপ করা বা একটি সমাজের মধ্যে ন্যায় সঙ্গত প্রবেশাধিকার পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে ওঠে।
অক্ষমতা জ্ঞানীয়,বিকাশমূলক,বুদ্ধিবৃত্তিক,শারীরিক, মানসিক, সংবেদনশীল বা একাধিক কারণের সংমিশ্রণে হতে পারে।অক্ষমতা জন্ম হতে পারে বা একজন ব্যক্তির জীবদ্দশায় অর্জিত হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে প্রতিবন্ধীতা বা বিকলাঙ্গ সমস্যা তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা ১।দূর্বলতা,২।অক্ষমতা,৩।প্রতিবন্ধীতা।
বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যান আাইন ২০০১ এ বলা হয়েছে যে, প্রতিবন্ধী অর্থ এমন এক ব্যক্তি যিনি জন্মগত ভাবে বা রোগাক্রান্ত হয়ে বা দূর্ঘটনায় আহত হয়ে বা অপচিকিৎসায় বা অন্য কোন কারণে দৈহিকভাবে বিকলাঙ্গ বা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন এবং উক্তরুপ বৈকল্য বা ভারসাম্যহীনতার ফলে স্থায়ীভাবে বা আংশিক ভাবে সম্পুর্ন ক্ষমতাহীন এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনে অক্ষম। কাজেই প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের কোন ভাবেই পারিবারিক, সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে অবহেলা করা একেবারেই অনুচিত।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বা প্রতিবন্ধী শিশুদের শিখনের ক্ষেত্রে শিক্ষকের করণীয়:
শিক্ষক হচ্ছেন জাতিগড়ার কারিগর। সমাজের একজন সচেতন নাগরিক। রাস্ট্রের একজন বা প্রজাতন্ত্রের একজন সদস্য হিসেবে সকল শিশুর শিক্ষায় সক্রিয় অংশগ্রহন নিশ্চিত করার মধ্যে দিয়ে শিক্ষা লাভের সুযোগ তৈরি করে দেয়া একজন শিক্ষক এর নৈতিক দায়িত্ব। শ্রেণিকক্ষে প্রতিবন্ধী শিশুর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিবন্ধী শিশুর প্রতি যাতে কেউ ব্যঙ্গ বা তিরস্কার না করতে পারে সে জন্য তাঁকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। শিক্ষক প্রতিবন্ধী শিশুর সাথে বেশি আন্তরিক হলে অন্যান্য শিশুরা তাঁকে গুরুত্ব দিবে এবং তার প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হবে।এতে করে স্বাভাবিক শিশুরা প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি উপলব্ধি থেকে সাহায্য করতে পারবে।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বা প্রতিবন্ধী শিশুদের শিখনে সহায়তা করতে একজন শিক্ষক নিন্মলিখিত বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন বা প্রয়োগ করবেন –
১।শ্রেণিক্ষে যদি শ্রবণ এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধী থাকে তবে তাকে সামনে বসতে দেওয়া।
২। প্রতিটি কাজের নির্দেশনা তাঁকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া।
৩। কোন কাজ দেওয়া হলে তাঁকে হাতেকলমে ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া বা কাজটি করতে সহায়তা করা।
৪। প্রতিবন্ধী শিশুর সাথে অন্য শিশু বা সুযোগ থাকলে তাঁর বাড়ীর আশেপাশের অন্য যেকোনো শিশুর সাথে জুটি বেঁধে দেওয়া যেন সে প্রতিবন্ধী শিশুকে বিদ্যালয়ে আসতে, যেতে, ক্লাসে শিখন শেখানো কার্যক্রমে,খেলাধূলায়,টয়লেটে যেতে, খাতা কলম ব্যাগ গুছিয়ে নিতে, রাস্তা পারাপার ইত্যাদি কাজে সহায়তা করতে পারে।
৫।প্রতিবন্ধী শিশুকে প্রদত্ত তুলনামূলক সময় বেশি দেওয়া।
৬। অন্যান্যদের ন্যায় তাদেরও নাম ধরে ডাকা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া।
৭। অবিভাবক / মা সমাবেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি তাদের দায়িত্ব – কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলা যেন প্রতিবন্ধী শিশু ও তার পরিবারকে সামাজিক কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করতে সবাই প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে পারে।
৮। প্রতিবন্ধী শিশু কে তাঁর কাজের জন্য উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেওয়া,
৯। তাদের প্রতিবন্ধী শিশু বলে অন্যান্য শিশুদের নিকট ছােট না করা।
১০। তাদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি / সামাজিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন উপকরণ, অনুদান প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।এবং তাদেরকে সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমে অংশ গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া ইত্যাদি।
তাই আসুন প্রতিবন্ধী শিশুদের গুরুত্ব দিয়ে তাদের শিখন নিশ্চিত করি।একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়ন করি।
লেখক:
মোঃ সাজু মিয়া, ইন্সট্রাক্টর,
উপজেলা রিসোর্স সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা ( প্রশিক্ষণ বিভাগ), সোনাতলা, বগুড়া।