ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি ||১৯৭১ সালের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার উত্তর সুহিলপুরের নদু মিয়া। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান রেখে মারা গেছেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছর পর। দুই সন্তান তখন সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে। স্বামী নদু মিয়ার মৃত্যুর পর এই দুই সন্তানকে নিয়ে স্ত্রী জুহেরা (৭৭) হয়ে গেলেন দিশেহারা। নতুন স্বাধীন হওয়া দেশে তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা নদু মিয়ার পরিবারের ছিল না বসবাস করার মতো নিজের বাসস্থান। থাকতেন স্থানীয় ভূইয়া বাড়িতে আশ্রয়ে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নদু মিয়ার মৃত্যুর পর স্ত্রী জুহেরা বেগম শুরু করেন জীবন-জীবিকার যুদ্ধ। অন্যের বাড়িতে আশ্রয়ে থেকে এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন নিজের সংসার। এভাবেই কেটে যায় দীর্ঘদিন। তবে পড়াশোনা করাতে পারেননি দুই সন্তানকে।
একমাত্র মেয়ে বড় হয়ে ওঠায় গ্রামবাসীর সহযোগিতায় তাকে বিয়ে দেন। ছেলে মুসলিম মিয়া (৪৫) সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে সংসারের হাল ধরেছিলেন। মুসলিম মিয়াও বিয়ে করেছেন। তার রয়েছে তিন মেয়ে ও দুই ছেলে সন্তান।
জুহেরা বেগম স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার ভাতার টাকা জমিয়ে এক শতাংশ জায়গা কিনেছেন। পরে ঋণ করে ওই জায়গায় একটি ঘর তুলেছেন। মুক্তিযোদ্ধার ভাতার যে টাকা পান সেই টাকার একটি অংশ ঘরের ঋণ হিসেবে পরিশোধ করছেন।
ঋণ করে মাথা গোঁজার ঠাঁই হতে না হতেই আবার অশনিসংকেত নেমে আসে জুহেরা বেগমের পরিবারে। একমাত্র ছেলে মুসলিম মিয়া পাইলসে আক্রান্ত হন। সেই পাইলস ইনফেকশন হয়ে ক্যান্সারে পরিণত হতে চলছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিকিৎসকরা তাকে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দিয়েছেন।
ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মুসলিম মিয়ার পাইলস দীর্ঘদিন চিকিৎসা না করানোয় খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। দ্রুত অপারেশন না করালে এটা ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে। কিন্তু এই অপারেশন করার সক্ষমতা নেই মুসলিম মিয়ার। সিএনজি চালানো বন্ধ। স্ত্রী, মা জুহেরা বেগম, পাঁচ সন্তানসহ আটজনের পরিবারে উপার্জনকারী কেউ না থাকায় খেয়ে বেঁচে থাকাই এখন কষ্টকর।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নদু মিয়ার স্ত্রী জুহেরা বেগম বৃদ্ধ বয়সে আবার এলাকার মানুষের বাড়ি বাড়িতে কাজ শুরু করেন। এভাবে গত দেড় বছর তিনি মানুষের বাড়িতে কাজ করে ছেলে মুসলিম মিয়ার চিকিৎসার খরচ ও পরিবারের খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন।
জুহেরা বেগম বলেন, ‘আমার জীবনটাই যুদ্ধের। দুই সন্তান রেখে স্বামী মারা গিয়েছিলেন। দুই সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করেছি। ছেলে সিএনজি চালিয়ে সংসারের হাল ধরেছিল। কিন্তু সে নিজেই এখন অসুস্থ। মানুষের বাড়িতে কাজ না করলে ছেলের চিকিৎসার টাকা ও ঘরের খাবার আসবে কীভাবে?’
জুহেরা বেগমের একমাত্র ছেলে মুসলিম মিয়া বলেন, ‘মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে সন্তান হিসেবে দেখতে খুব কষ্ট লাগে। কিন্তু আটজনের সংসারে আয় করার মতো কেউ নেই। আমার চিকিৎসাও ঠিকভাবে চালাতে পারছি না। বাবার মুক্তিযোদ্ধার যে ভাতা পাই, তার একটি অংশ ঘরের ঋণে চলে যায়।’ তিনি বিত্তবানদের কাছে সহায়তা কামনা করেন।
সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আজাদ হাজারী আঙ্গুর বলেন, ‘এ বিষয়ে কেউ আমাকে অবগত করেননি। সহায়তার আবেদন করলে আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠাব।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত মানবিক। আমরা তাদের পাশে সার্বক্ষণিক থাকার চেষ্টা করব।’
তিনি বলেন, সরকার অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গৃহনির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যদি তারা সেই কোটার মধ্যে পড়েন, আমরা তারও ব্যবস্থা করব।