আশরাফুল হক, লালমনিরহাট: বাল্যবিয়ে মুক্ত জেলা লালমনিরহাটে অপ্রাপ্ত এক ছেলের ৩বিয়ের ঘটনায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ৪ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইবুনালে মামলার আবেদন করেছেন নিকাহ রেজিস্ট্রার। রংপুর আদালতে সাইবার ট্রাইবুনালে মামলার আবেদন করেছেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্টার কাজী ওমর আলী। তিনি আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ছাবেরা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষক।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক রাজু মিয়া আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের গন্ধমরুয়া গ্রামের আউয়াল মিয়ার ছেলে। তার জন্ম সনদ (১৫/১২/২০০৩) অনুযায়ী বয়স কুড়ি বছর অতিক্রম হলেও সরকারী বিধিমতে ২১ বছরের আগে বিয়ের সুযোগ নেই। অথচ কুড়ি বছরেই ৩টি বিয়ে মধ্যে ও ২টি বিবাহ বিচ্ছেদ করেছেন তিনি।
সাইবার ট্রাইবুনালে দায়ের করা অভিযোগের অভিযুক্ত সংবাদকর্মীরা হলেন, আজকের বিজনেস বাংলাদেশ পত্রিকার লালমনিরহাট প্রতিনিধি আশরাফুল হক, এশিয়ান টিভি ও জবাবদিহি পত্রিকার নিয়ন দুলাল, দৈনিক নবচেতনা'র লিয়াকত আলী ও দৈনিক লাখকন্ঠের আব্দুর রাজ্জাক।
জানা গেছে, আদিতমারী উপজেলার গন্ধমরুয়া গ্রামের আউয়াল মিয়ার ছেলে রাজু মিয়া দুই বছর আগে প্রায় ১৮ বছর বয়সে প্রথম বিয়ে করেন মোগলহাট ইউনিয়নের ভাটিবাড়ি গ্রামের ফজলু হকের কিশোরী মেয়ে ফারজানাকে। বর কণে দু'জনের বয়স কম থাকায় বিয়ে রেজিস্ট্রি হলেও নকল দেননি পাশ্ববর্তি মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্টার কাজী ওমর আলী। বিয়ের এক মাসের মধ্যে তাদের সংসারে বিচ্ছেদের সুর বেজে উঠে। নকল না থাকায় আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেননি মেয়ের পরিবার। অবশেষে বিয়ের এক বছরের মাঝে একই নিকাহ রেজিস্টারের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাদের।
বিচ্ছেদের পরে একই ভাবে দুর্গাপুর গ্রামের আমিনুল হকের মেয়ে স্থানীয় ছাবেরা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রুপালী খাতুনকে(১৩) দ্বিতীয় বিয়ে করেন রাজু মিয়া। দ্বিতীয় বিয়ে রেজিস্ট্রি করেন রুপালীর স্কুলের মৌলভী শিক্ষক মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্টার কাজী ওমর আলী। বর কণে দু'জনে অপ্রাপ্ত হওয়ায় নকল দেননি কাজী ওমর আলী। সেই বিয়েতেও এক মাস পরে বিচ্ছেদের সুর বেজে উঠে। আবারও সমস্যায় পড়েন বর ও কণের পরিবার। নকল না দেয়ায় কোন পক্ষই নিতে পারছিল না আইনি পদক্ষেপ।
অবশেষে বর রাজু মিয়া রুপালীকে বিয়ে করেছেন মর্মে লিখিত দিয়ে গত বছরের ২৪ নভেম্বর তাদের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটান। তবে এ বিচ্ছেদের নোটিশ ফেরত পাঠান রুপালীর পরিবার। রাজুর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বিয়ের নকল চেয়ে দফায় দফায় নিকাহ রেজিস্টার ওমর আলীর সাথে যোগাযোগ করেন রুপালীর পরিবার। এ দিকে রাজু পুনরায় প্রথম স্ত্রীকে তৃতীয় বিয়ে করে ঢাকায় পাড়ি জমান।
বারবার নাবালক ছেলের বাল্যবিয়ে দিয়ে ফিস আদায় করলেও নকল না দেয়ায় আলোচনায় আসেন কাজী ওমর আলী। একই সাথে নিজে শিক্ষক হয়ে তার বিদ্যালয়ের নাবালিকা শিক্ষার্থীর বিয়ে দিয়ে বৈধ কাগজ না দেয়ার প্রতারনার বিষয়টি অনুসন্ধানে নামেন চার জন সংবাদকর্মী। তারা রুপালীর পরিবারের সকল সদস্য, বিয়ের স্বাক্ষী ঘটকসহ সংশ্লিষ্টদের ভিডিও স্বাক্ষাতকার নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
গনমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা রেজিস্টার লিখিত কৌফিয়ত তলব করে মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিটার কাজী ওমর আলীকে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গত ১৫ জানুয়ারি চার সংবাদকর্মীর বিরুদ্ধে রংপুর সাইবার ট্রাইবুনালে মামলার আবেদন করেন কাজী ওমর আলী। বিচারক অভিযোগটি তদন্ত করতে লালমনিরহাট সদর থানাকে দায়িত্ব প্রদান করেছেন।
অভিযুক্ত সংবাদিক আশরাফুল হক বলেন, বাল্যবিয়ের শিকার কিশোরীর পরিবার বিয়ের নকল না পেয়ে ন্যায় বিচার বঞ্চিত হচ্ছে এমন অভিযোগে ভিক্টিম, তার পরিবার ও বিয়ের সংশ্লিষ্ট সকলের ভিডিও স্বাক্ষাতকার ও প্রমানিক কিছু দলিল সংগ্রহ করে অনুসন্ধানি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহের জন্য এবং গনমাধ্যমকে সংকোচিত করতে মিথ্যে মামলার আবেদন করেছেন নিকাহ রেজিস্টার। যা আইনি ভাবে মোকাবেলা করা হবে।
সদর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) ওমর ফারুক বলেন, আদালতের নির্দেশে অভিযোগটি তদন্ত চলছে। তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
৭ বছর আগে লালমনিরহাটকে বাল্যবিয়ে মুক্ত জেলা ঘোষনা করা হয়। এ ঘোষনা কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ রেখে দেদারছে চলছে বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ে ঠিকাতে গিয়ে হামলার শিকারও হচ্ছেন অনেক সমাজকর্মী। যার অভিযোগ দায়ের করেও কোন সুফল মিলছে না। একটি সুত্রের দাবি, জেলার প্রায় সকল নিকাহ রেজিস্টারের গোপন ভলিয়ম রয়েছে। বাল্যবিয়ে রেজিস্ট্রি হয় গোপন ভলিয়মে। যার প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত নকল দেয়া হয় না। বাল্যবিয়ে দেয়া অপরাধ ভেবে অভিভাবকরাও বিয়ের সময় নকল দাবি করেন না। সংসারে বনিবনা না ঘটলেই নকল খুজে উভয় পরিবার। নকল না পেয়ে অনেক মেয়ের পরিবার নিতে পারছেন না আইনি কোন পদক্ষেপ। ফলে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন অনেকেই। আবার কতিপয় নিকাহ রেজিস্টারের অর্থলোভীর কারনে অনেক কিশোর কিশোরী বই ছেড়ে টানছেন সংসারের ঘানি। কেউ আবার সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে কিশোরী বয়সেই স্বামী পরিত্যাক্তার গ্লানি নিতে হচ্ছে।
ছাবেরা খাতুন বালিকা বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষক নিজে নিকাহ রেজিস্টার হওয়ায় ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছেন বলে স্থানীয়দের দাবি। নিজস্ব ইউনিয়নের বাহিরে বিবাহ রেজিস্ট্রি করা বিধি বহির্ভুত হলেও স্কুল শিক্ষক হিসেবে দুর্গাপুরে যাতায়ত করায় দুর্গাপুরের বাল্যবিয়ে রেজিস্ট্রি করেন মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্টার কাজী ওমর আলী। এমন অভিযোগ তুলে দুর্গাপুর ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্টার কাজী মাহমুদুল হাসান জুয়েল বলেন, অপ্রাপ্তরা বিয়ের জন্য আসলে আমি তাদেরকে বুঝিয়ে ফেরত পাঠাই। অথচ মোগলহাটের নিকাহ রেজিস্টার দুর্গাপুরের স্কুল শিক্ষক হিসেবে এসব বাল্যবিয়ে পড়াচ্ছেন। বেশ কিছুদিন হাতেনাতে বাল্যবিয়ে রেজিস্টির দৃশ্য দেখে তাকে নিষেধ করেছি। কিন্তু তিনি তা মানছেন না। তার কারনেই দুর্গাপুরে বাল্যবিয়ে বাড়ছে। ২০১৮ সালের ৮ মার্চ বাল্যবিয়ের দায়ে কাজী ওমর আলীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। এতকিছুর পরেও তিনি সতর্ক হচ্ছে না।
মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্টার ও ছাবেরা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষক কাজী ওমর আলী বলেন, রাজু'র আগের বিয়ে এবং তার বিচ্ছেদও আমার মাধ্যমে হয়েছে। তবে রুপালীর সাথে রাজুর দ্বিতীয় বিয়ে আমি রেজিস্ট্রি করি নি। রাজুর প্রথম বিয়ের বর কণে অপ্রাপ্ত থাকলেও সে বাল্যবিয়ে কিভাবে দিলেন - এমন প্রশ্নের কোন জবাব দেননি তিনি। তবে রাজুর দ্বিতীয় স্ত্রী রুপালী বলেন, আমার স্কুলের মৌলভী স্যার ওমর আলী আমাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করেছেন এবং বিয়ে পড়িয়েছেন। কিন্তু নকল দেননি।
ছাবেরা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাধব চন্দ্র সাহা বলেন, বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষক ওমর আলী নিকাহ রেজিস্টার কাজের জন্য বিদ্যালয় থেকে কোন ধরনের অনুমতি গ্রহন করেন নি। আর আমার বিদ্যালয়ের নাবালিকা শিক্ষার্থীর বিয়ের ঘটনাটি গনমাধ্যমে জেনেছি।
বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সভাপতি সিরাজুল হক বলেন, আমরা বাল্যবিয়েকে লাল কার্ড দেখাতে প্রায় সমাবেশ করে থাকি। সেখানে বাল্যবিয়ের কুফল নিয়ে বক্তব্য রাখেন মৌলভী শিক্ষক কাজী ওমর আলী। তিনি যদি বাল্যবিয়ে রেজিস্ট্রি করেন তবে তা দুঃখজনক। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিব।
হাতীবান্ধা উপজেলার টংভাঙ্গা ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্টার কাজী গোলাম মোস্তফা বলেন, চলতি সপ্তাহে নিজ ইউনিয়নের পশ্চিম বেজগ্রামে একটি বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে দেখি গেন্দুকুড়ি কলেজের অধ্যক্ষ হারুন আর রশিদ বিবাহ রেজিস্ট্রি করাচ্ছেন। পরে তাকে ভলিয়ম বহি সহ আটক করলেও স্থানীয়দের অনুরোধে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এমন ভুয়া নিকাহ রেজিস্টাররা বাল্যবিয়ে ও ভুয়া বিচ্ছেদের অপকর্ম করে আসছে। এদের দৌড়াত্ব রোধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
এদিকে বাল্যবিয়ে ঠিকাতে গিয়ে কমলাবাড়ি ইউনিয়ন নিকাহ রেজিস্টারের সহকারী রফিকুল ইসলামের হামলার শিকার হয়েছেন কালীগঞ্জ উপজেলার চলবলা ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম। প্রতিকার চেয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারী জেলা রেজিস্টার বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন আওয়ামীলীগ নেতা। মুলত কতিপয় নিকাহ রেজিস্টারের কারনে বাল্যবিয়ে মুক্ত জেলা লালমনিরহাটে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বাল্যবিয়ে। একই কারনে ভুয়া বিবাহ আর বিবাহ বিচ্ছেদও ঘটছে উদ্বেগজনক হারে। জেলার প্রায় ২৫/৩০ জন নিকাহ রেজিস্টার দ্বৈত পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। যার বেশির ভাগই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ফলে তারা নিজেরা নিকাহ রেজিস্টার নিয়োগ নিয়ে অপর একাধিক সহকারীর মাধ্যমে বিবাহ রেজিস্ট্রি করছেন। এসব সহকারী নামের ভুয়া নিকাহ রেজিস্টারের কারনে লালমনিরহাটে বাড়ছে বাল্যবিয়ে। যার কবলে পড়ে বিয়ের নকলের অভাবে অনেক কিশোরী তার ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন। বাল্যবিয়ে রোধে নিকাহ রেজিস্টারদের সহকারী রাখার নামে ভুয়া রেজিস্টারের দৌড়াত্ব কমাতে হবে। একই সাথে নিজ অধিক্ষেত্রে নিকাহ রেজিস্টারদের দায়িত্ব পালন এবং বিবাহ নিবন্ধন ডিজিটাল করার জোর দাবি সচেতন মহলের।
জেলা রেজিস্টার খালিদ বিন আসাদ বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে প্রায় সমাবেশ করা হচ্ছে। নিকাহ রেজিস্টারদের অধিক্ষেত্রের বাহিরে এবং সহকারী রাখার কোন নিয়ম নেই। মেয়ের ১৮ এবং ছেলের ২১ বছরের আগে বিয়ে আইনত অপরাধ। বাল্যবিয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্তসহ অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট নিকাহ রেজিস্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। গোপন ভলিয়মে বাল্যবিয়ে ও ভুয়া বিচ্ছেদ ঠেকাতে বিবাহ নিবন্ধন ডিজিটাল করার প্রস্তাব করেন তিনি। যেখানে বিবাহ এবং বিচ্ছেদের তথ্য অনলাইনে থাকবে। যা তাৎক্ষণিক নকলও পাওয়া সম্ভব হবে। এমনটা করা হলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি মিলতে পারে বলেও প্রস্তবনা দিয়েছেন তিনি।