এম এ মাসুদ: আজ জুন মাসের তৃতীয় রোববার ‘বিশ্ব বাবা দিবস।’ দুই অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ বাবা। শব্দটি তুর্কী শব্দ। যার অর্থ জনক কিংবা পিতা।
ধর্ম, বর্ণ যাই হোক না কেন পৃথিবীর সকল বাবার ধর্মই এক ও অভিন্ন। ভৌগোলিক সীমারেখার পার্থক্য থাকলেও স্নেহ, মমতা, ভালোবাসায় নেই সেই পার্থক্য। সন্তান জন্মের পর থেকেই নিজের সকল সাধ, আহ্লাদকে বিসর্জন দেন একজন বাবা। আর্থিক দিক ছাড়াও কী করলে সন্তান সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে, সুশিক্ষা পাবে, সুখে থাকবে তার ব্যবস্থা করে থাকেন একমাত্র বাবা। উচ্চ শিক্ষিত হয়ে সন্তান যাতে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে সেজন্য চেষ্টার কোনো ঘাটতি থাকে না তাদের। এমনকি সন্তানের সামান্য অসুখ-বিসুখেও বিচলিত হয়ে পড়েন একজন বাবা।
সন্তান হুমায়ুনের জন্য মোঘল সাম্রাজ্যের স্থপতি সম্রাট বাবরের জীবন উৎসর্গ করার সেই কিংবদন্তি ঘটনার কথা কে না জানে!
মোঘল সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন অসুস্থ হয়ে পড়লে স্রষ্টার কাছে তিনি প্রার্থনা করেছিলেন নিজের জীবনের বিনিময়ে হুমায়ুনের জীবন ফিরিয়ে দিতে। আল্লাহ সম্রাট বাবরের সেই প্রার্থনা কবুলও করেছিলেন। ধীরে ধীরে হুমায়ুন সুস্থ হয়ে উঠছিলেন আর কয়েকমাস পর বাবা বাবর ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এক পর্যায়ে অসুখ প্রকট আকার ধারণ করেছিল এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন বাবার। সন্তানের প্রতি একজন স্নেহবৎসল বাবার এই মহান আত্নত্যাগ ফুটিয়ে তুলেছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর “জীবন বিনিময়” কবিতার মাধ্যমে। যার শেষ চরণ দু’টি ছিল এমন “মরিয়া বাবর অমর হইয়াছে, নাহি তার কোনও ক্ষয়, পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়।” শুধু মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই নয়, সন্তানের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছেন একজন স্নেহপরায়ন বাবা হিসেবেও।
শুধু বাবর নন, সন্তানের প্রতি পৃথিবীর কোনো বাবার ই আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা পরিমাপ যোগ্য নয়। পরিমাপ যোগ্য নয় সন্তানকে নিয়ে বাবার স্বপ্নগুলোও। বাবা হলেন শক্তি, সাহস ও পরম নির্ভরতার প্রতীক। চিন্তাভাবনা আর সারাজীবন হার ভাঙা খাটুনির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ সবই সন্তানের জন্য তিল তিল করে জমা করেন তিনি। নিজে কষ্ট করলেও সন্তানকে ছুঁতে দেন না সেই কষ্ট বা অভাব। টাকার গায়ে মুদ্রিত রয়েছে ‘চাহিবা মাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’ ঠিক যেন সন্তানের ক্ষেত্রেও অমন একটি বাক্য প্রযোজ্য। আর তা হলো ‘চাওয়া মাত্রই সন্তানের চাহিদা পুরণে সদা সচেষ্ট থাকেন বাবা।’ এজন্যই তো বাবার অপর নাম ছায়াদানকারী বটবৃক্ষ।
কিন্তু যার বাবা নেই, সেই একমাত্র বোঝে বাবা নামক বটবৃক্ষটি বেঁচে না থাকার কষ্টটা ঠিক কোথায়?
সন্তানের প্রতি যাদের এতো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা সেই বাবার প্রতি সম্মান জানাতেই প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বের ১১১টির মতো দেশে পালিত হয় বিশ্ব বাবা দিবস। বাবার এতো অবদান থাকা সত্বেও এমন অনেক সন্তান আছে যারা তাদের বাবা-মার সেবাযত্নের প্রতি থাকে অনেকটা উদাসীন। বাবা দিবস আসে তাদের চোখের সামনের আচ্ছাদিত পর্দা খুলে দিতে। স্মরণ করিয়ে দেয় বাবার প্রতি সন্তানদের দায়িত্ববোধের কথা। এমনিতে অধিকাংশ বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা থাকে সর্বদাই। যা সুনির্দিষ্ট কোনো দিন বা ক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তারপরও বিশ্ব বাবা দিবসে বাবাদের অবদানকে সমাজ ও সন্তানরা যে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করছে, তা পৃথিবীর সকল বাবাকে নিশ্চয়ই আনন্দিত করে।
সন্তানের জন্য বাবা যে স্নেহ, ভালোবাসা ও ত্যাগ স্বীকার করেন তার ঋণ কখনো শোধ করা যাবে না। সন্তানের সামান্যতম অবাধ্যতাও কিন্তু বাবা-মার মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং কোনো কথাবার্তা, আচরণেও যেন তারা মনঃকষ্ট না পান, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে সন্তানদের। বৃদ্ধ বয়সে তাদের সেবাযত্নের যেন কোনো ত্রুটি না হয় সেদিকে রাখতে হবে সজাগ দৃষ্টি। বাবা-মার সন্তুষ্টি বিধান করার মধ্যেই সন্তানের প্রকৃত কর্তব্য নিহিত। বাবা-মাকে খুশি করতে পারলে আল্লাহও আমাদের প্রতি প্রসন্ন থাকবেন। হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন, মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত। আবার ইসলাম এটাও শিক্ষা দেয় যে, পিতার অসন্তুষ্টি সন্তানের সকল কাজের অন্তরায়।
জনসংখ্যা বিজ্ঞান ও জনসংখ্যা বিশ্লেষণ বইয়ের প্রচ্ছদে দেখেছিলাম মানুষের জীবনচক্র এমনঃ শিশু-কৈশোর-যৌবন-প্রৌঢ়-বার্ধক্য-মৃত্যু। এ জীবনচক্র থেকে সহজেই অনুমেয় সবার পরিণতি ঠিক কিন্তু একই।
তাই বাবা-মায়ের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব রয়েছে তা যেন আমরা যথাযথভাবে পালন করতে পারি। সৌভাগ্যবান তো তারাই যাদের বাবা-মা বেঁচে আছে।
সুতরাং বাবা-মায়ের সেবাযত্ন করা সুবর্ণ সুযোগকে যেন কোনোভাবেই আমাদের হাত ফসকে না যায়। অন্যথায় আফসোস করতে হবে অনন্তকাল।
/এম এ মাসুদ,
কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী