৪৯ বছর আগে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই ১৬ই ডিসেম্বরে এসেছিল বাংলার স্বাধীনতা। যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের ৭ই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’বলে জাতিকে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিলেন, সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই পরাজয় মেনে নিয়ে মাথা নত করে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য অস্ত্র সমর্পণ করেছিল বাঙালি জাতির বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।
আজ ১৬ই ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরব ও অহংকারের দিন। লাখ লাখ বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্তস্রোত, স্বামী-সন্তানহারা নারীর অশ্রুধারা, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা আর বীরাঙ্গনাদের সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে অর্জিত হয়েছিল মহান এই বিজয়। ৪৯ বছর আগে এই দিনে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছিল আত্মপরিচয়ের ঠিকানা। আজ কৃতজ্ঞ জাতি সশ্রদ্ধ বেদনায় স্মরণ করবে দেশের বীর সন্তানদের। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে জনতার ঢল নামবে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সব প্রান্তের মানুষ অংশ নেবে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে।
বিজয়ের ৪৯ বছর পেরিয়ে এবার ৫০তম বিজয় দিবস। এবারের বিজয় দিবস এসেছে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে। ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং সামনের বছর ২০২১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে বাংলাদেশ। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে পৃথক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
সাভারে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে প্রস্তুত জাতীয় স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধের সৌন্দর্য বর্ধনের বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিক্তি সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, ইতিমধ্যে পুরো স্মৃতিসৌধের পাকা অংশে ধোয়ামোছার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে জাতীর সূর্যসন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সরদার জানান, নির্বিঘ্নে দিবসটি পালন করার জন্য জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকায় তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে মোতায়েন করা হয়েছে কয়েক শ সামরিক ও বেসামরিক নিরাপত্তাকর্মী। ইতিমধ্যে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে সুইপিং করা হয়েছে।
বিজয় এলো যেভাবে : পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা আর অবহেলা চরম আকার ধারণ করলে প্রতিবাদে ক্রমে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে এই অঞ্চল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে তারা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভকারী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে টালবাহনা শুরু করে শাসকগোষ্ঠী। ফলে ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান। একাত্তরের ৭ মার্চ তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ জনগণের স্বাধীনতার স্পৃহাকে প্রবল করে তোলে। ঢাকা যখন অগ্নিগর্ভ, তখন পাকিস্তানি শাসকচক্র আমাদের মুক্তির স্পৃহাকে দমনের পথ বেছে নেয়। রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষ হত্যার মাধ্যমে জন্ম দেয় ২৫ মার্চের কালরাতের। এর পরই চূড়ান্ত হয়ে যায় আমাদের পৃথক পথচলার যাত্রা। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় চূড়ান্ত লড়াই। দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিসংগ্রামের পর পরাজয় মেনে নেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ১৯৭১ সালের আজকের দিনে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী নিয়ে ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরার কাছে। শুরু হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পথচলা।
কর্মসূচি : ঢাকায় ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা করা হবে। তবে করোনা মহামারির জন্য এবারের সব আয়োজন কিছুটা নিয়ন্ত্রিত। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে বলে জানা গেছে। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
বিজয় দিবস সরকারি ছুটির দিন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোর প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপ জাতীয় পতাকায় সজ্জিত করা হবে। গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় করা হয়েছে আলোকসজ্জা। হাসপাতাল, কারাগার ও এতিমখানাগুলোতে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। সংবাদপত্র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবে, বেতার ও টিভি চ্যানেলগুলো সম্প্রচার করবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
আওয়ামী লীগ : আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্য রয়েছে, ভোরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৯ টায় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন। ১০টায় ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। সকাল সাড়ে ৯টায় টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল।
এদিকে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনাসভা আজ বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য রাখবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জাতীয় পার্টি-জেপি : মহান বিজয় দিবসে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন জাতীয় পার্টি-জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি এবং দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম। গতকাল এক বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় বলেন, ১৯৭১ সালের এই দিন বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছিল এক অবিস্মরণীয় বিজয়ের। এই উপলক্ষ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আত্মোত্সর্গকারী সব মুক্তিবাহিনী, সশস্ত্র ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও আত্মদানকারী সদস্যদের এবং ৩০ লাখ শহিদের স্মৃতিকে স্মরণ করছি বিনম্র্র শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসায়। আমাদের হূদয়ের গভীরতম শ্রদ্ধা জানাচ্ছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তারা আরো বলেন, আমরা জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিপুল অগ্রগতি সাধন করেছি এবং বিশ্বের বুকে আজ বাংলাদেশ নামটি সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। আজকের দিনে আমাদের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, পশ্চাত্পদ চিন্তা ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে শপথ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের শপথ হবে দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে সুশাসন, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
দিবসটি উপলক্ষ্যে আজ সকাল সাড়ে ৬টায় জেপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সব দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং সকাল ৮টায় সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও মুক্তিযুদ্ধে বীর শহিদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। বাদ জোহর মসজিদে শহিদদের রুহের মাগফেরাত কামনায় দোয়া ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা করা হবে।