মানসিক রোগী ভর্তির পরই তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এতে ভয় পেয়ে রোগী যাতে উৎপাত না করে, সে জন্য সাউন্ডপ্রুফ কক্ষে নেওয়া হয়ে থাকে। রোগী বেশি উত্তেজনা দেখালে সেখানে তাকে শায়েস্তা করতে মারধর করা হয়। চিকিৎসা পদ্ধতির অংশ হিসেবেই পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল করিমকে বিশেষ কক্ষে নেওয়া হয়। এক পর্যায়ে তিনি সবাইকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে তাকে মারধর করা হয়। সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার মাইন্ড এইড হাসপাতালের ১০ কর্মী গতকাল বুধবার পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, রিমান্ডে থাকা ওই আসামিরা বলেছেন, তাদের হাসপাতালে রোগী এলে তারা প্রথমে সাউন্ডপ্রুফ কক্ষে নিয়ে যান। এর আগেও অনেককেই তারা এরকম মারধর করেছেন। কিন্তু গত সোমবার ভর্তি হওয়া রোগী যে পুলিশের কর্মকর্তা, সেটা তারা জানতেন না। তিনি যখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, তখন তার পরিচয় জানাজানি হয়।
পুলিশ ক্যাডারের ৩১ ব্যাচের কর্মকর্তা আনিসুল করিম বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত ছিলেন। গত সোমবার সকালে স্বজনরা মানসিকভাবে অসুস্থ এই কর্মকর্তাকে রাজধানীর আদাবরে অবস্থিত মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে যান। ভর্তির পর তাকে হাসপাতালের কর্মীরা ওয়াশরুমে নেওয়ার কথা বলে দোতলায় নিয়ে যান। ওই সময় আনিসুলের বোন সঙ্গে যেতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন, তাকে অন্য হাসপাতালে নিতে হবে। পরে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, আনিসুলকে ৮-১০ জন মিলে মারধর করছেন। পেছন থেকে তার হাত বেঁধে নির্যাতন চালানো হয়। ওই ঘটনায় গত মঙ্গলবার নিহত আনিসুলের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ বাদী হয়ে হাসপাতালের পরিচালকসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদাবর থানায় হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় পুলিশ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে ১০ জনকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সমকালকে বলেন, এরই মধ্যে অবৈধ হাসপাতালটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রিমান্ডে থাকা ১০ আসামি আনিসুলের ওপর নির্যাতনের কথা স্বীকার করেছেন। পুরো নির্যাতনের দৃশ্যই সিসি ক্যামেরায় রয়েছে।
রিমান্ডে থাকা ১০ আসামি হলেন- হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, কিচেন সেফ মো. মাসুদ, ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান, ওয়ার্ডবয় তানিফ মোল্লা, জোবায়ের হোসেন, সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, লিটন আহাম্মেদ ও ওয়ার্ডবয় সাইফুল ইসলাম পলাশ। এ ছাড়া ওই হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াজ মোর্শেদকে গ্রেপ্তার করা হলেও অসুস্থ থাকায় তাকে আদালতে হাজির করা হয়নি।
জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, আসামিদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মনে হয়েছে, মাইন্ড এইড হাসপাতালে ভর্তির পরই মানসিক রোগীদের মারধর করা হতো। কোনো রোগী যাতে উত্তেজনা সৃষ্টি বা ভাঙচুর করতে না পারে, সে জন্য নির্যাতন করা হতো। হাসপাতালটির এই অপচিকিৎসারই বলি হয়েছেন আনিসুল করিম।
পুলিশের ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, আনিসুলকে নির্যাতনের পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কিনা তাও তদন্ত করা হচ্ছে। তাকে কাদের প্ররোচনায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে কথিত এই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মাইন্ড এইড হাসপাতালের কর্মীরা মানসিক অসুস্থ ব্যক্তিকে বিশেষ কক্ষে নিয়ে মারধরকে তাদের 'চিকিৎসা পদ্ধতি' বলে দাবি করলেও এটাকে ভয়ংকর ব্যাপার বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, এটা কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি হতে পারে না। মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য নির্যাতনের প্রয়োজনই নেই। তারা কেন ওই বিশেষ কক্ষটি তৈরি করেছিল, তা পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা, পুলিশের মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার মৃত্যুঞ্জয় দে সজল সমকালকে বলেন, আনিসুল করিমকে মারধর ও নির্যাতন করে হত্যার বিষয়টি পরিস্কার। এখন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে এ ঘটনায় আসামিদের কার কী ভূমিকা ছিল, সেটা যাচাই করা হচ্ছে। ফুটেজ বিশ্লেষণের পাশাপাশি রিমান্ডে থাকা আসামিদের কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হচ্ছে।
ওই হাসপাতালের এক কর্মী সমকালকে বলেন, শুধু নির্যাতন নয়, যেসব রোগী উত্তেজনা করত, তাদের ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিনের পর দিন ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো। কারণ ওইসব রোগীর জন্য অন্য রোগীরা ঘুমাতে পারত না। তারা ভাঙচুরও করত। এ জন্য তাদের ঘুমের ওষুধ দিয়ে সাউন্ডপ্রুফ কক্ষে আটকে রাখা হতো। তবে সেখানে থাকা সিসি ক্যামেরায় নার্সরা সব দেখভাল করতেন।
মাইন্ড এইড মানসিক হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল :স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন না থাকলেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) লাইসেন্স ছিল মাইন্ড এইড মানসিক ও মাদকাসক্তি নিরাময় হাসপাতালের। গতকাল বুধবার সেই লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। ডিএনসি পরিচালক (চিকিৎসা ও পুনর্বাসন) মু. নুরুজ্জামান শরীফ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করা এবং এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানানো হয়।