জাকির হোসেন,ঢাকা:: ২০২ সদস্যের নতুন কমিটি, মুক্তি পেলে স্বপদে ফিরবেন কারাবন্দিরা, নির্বাচনে অংশ না নিলেও থাকবে দিকনির্দেশনা, ১৩ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে অনড়
কওমি মাদরাসাভিত্তিক আলোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম নতুন করে আলোচনায় এসেছে সম্প্রতি ২০২ সদস্যের বিশাল কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে। প্রায় দুই বছর ধরে অনেকটা ঝিমিয়ে পড়া হেফাজতে ইসলামকে নতুন করে আলোচনায় আনতে চাচ্ছেন বর্তমান কমিটির নীতি-নির্ধারকরা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আবার সরব হতে চায় আলোচিত এই সংগঠনটি।
দেশে নির্বাচন এলে বরাবরই কদর বাড়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর। বড় একটি জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করার কারণে হেফাজতে ইসলাম বিভিন্ন সময় গুরুত্ব পেয়ে আসছে। নির্বাচনের আগে স্বাভাবিকভাবেই তাদেরও কদর বেড়েছে। বিরোধী দলগুলো নিয়মিত হেফাজতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। আবার সরকারের সঙ্গেও হেফাজতের ‘বোঝাপড়া’ বেশ ভালো।
ভোটকে সামনে রেখে দুই শিবির থেকেই গুরুত্ব পাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ে এটাকে একটা বড় সুযোগ হিসেবে দেখছে সংগঠনটি। এজন্য সাংগঠনিকভাবে তৎপর হয়ে উঠতেই কমিটি সম্প্রসারিত করা হয়েছে। যদিও এই কমিটি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কিছুটা অসন্তোষের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। তবে সেটা বাইরে আসতে দিচ্ছে না হেফাজত।
কী বলছেন হেফাজত নেতারা:
বৃহৎ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে হেফাজতের নতুন করে সরব হওয়া এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংগঠনের অবস্থান নিয়ে ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা হয় দুজন কেন্দ্রীয় নেতার। সংগঠনটির নায়েবে আমির মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী নতুন কমিটি প্রসঙ্গে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নতুন কমিটির মধ্য দিয়ে আমাদের নতুন করে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মাত্র কমিটি গঠন করা হয়েছে। নতুন এই কমিটিতে যুব নেতৃত্বকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর আগে আমাদের আমিরে হেফজত বাবুনগরী এবং তারও আগে আল্লামা আহমদ শফী সাহেব তাদের দুইজনের যে কমিটি ছিল, সেগুলোর সমন্বয়ে নবীন-প্রবীণ মিলিয়ে নতুন কমিটি করা হয়েছে। যুবকদের উদ্যমী চেতনা ও প্রবীণদের বুদ্ধি পরামর্শে নতুন করে পরিচালিত হবে আমাদের এই সংগঠন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হেফাজতের আগের কমিটির এক নেতা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘হেফাজত এখন পুরোটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। মূলত এই কমিটিও হয়েছে সরকারের দেওয়া প্রেসক্রিপশনে। সরকারের আপত্তির কারণেই মাওলানা মামুনুল হককে কমিটিতে রাখা হয়নি। নতুন করে যত কর্মসূচিই দেওয়া হোক হেফাজত আর আগের সেই অবস্থান ও ইমেজ ফিরে পাবে না। কারণ সংগঠনের মূল নেতৃত্বের প্রতি আগের সেই আস্থা আর নেতাকর্মীদের নেই।’
হেফাজতের কমিটিতে সংগঠনটির আলোচিত নেতা কারাবন্দি মাওলানা মামুনুল হকও থাকবেন বলে জানানো হয়েছিল। তবে ঘোষিত কমিটিতে নাম নেই মাওলানা মামুনুল হকের। এ প্রসঙ্গে মুহিউদ্দীন রাব্বানী বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট বৈঠকে আমাদের একটা সিদ্ধান্ত ছিল যে, জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেব ২০২০ সালে যে কমিটি ঘোষণা করেছিলেন তাদের বর্তমান কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এটা আমরা গণমাধ্যমকেও জানিয়েছিলাম। বর্তমানে কারাগারে আছেন মাওলানা মামুনুল হক। তিনি যদি জুনায়েদ বাবুনগরীর কমিটিতে থেকে থাকেন তবে তিনিও এই কমিটিতে থাকবেন। যদিও পদবি আসেনি, কিন্তু কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন। মাওলানা মামুনুল হক সাহেবসহ যারা এখনো জেলে আছেন তারা মুক্তি পাওয়ার পর যথাস্থানে তাদের পদায়ন করা হবে।’
নির্বাচনে কার পক্ষে থাকবে হেফাজত-এমন প্রশ্নের জবাবে মুহিউদ্দীন রাব্বানী বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। নির্বাচনমুখী দেশ হলেও এখনো নির্বাচনের আবহ তৈরি হয়নি। নির্বাচন কমিশন এখনো তফসিল ঘোষণা করেনি। নির্বাচন সামনে চলে এলে কী হয় না হয় বলা যাচ্ছে না। নির্বাচনের পরিবেশ শুরু হলে আমিরে হেফাজত অবশ্যই একটা ঘোষণা দেবেন দেশ-জাতির জন্য। কারণ দেশে যেন একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যেন অক্ষুণ্ন থাকে, দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি যেন না হয়, দেশের সম্পদের যেন ক্ষতি না হয়- এ ব্যাপারে আমি মনে করি তিনি অবশ্যই একটা দিকনির্দেশনা দেবেন।’
তবে হেফাজতের আরেক নেতা মাওলানা কেফায়াতুল্লাহ'র সঙ্গে আলাপকালে জানান, আগামী নির্বাচনে হেফাজতের কোনো ভূমিকা থাকবে না। কারণ এটি অরাজনৈতিক সংগঠন। তিনি বলেন, ‘আমাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আগের কার্যক্রম যেভাবে চলছে ইনশাআল্লাহ এখনো সেভাবেই চলবে। ধর্মবিরোধী কোনো কার্যক্রম চললে সেটা মোকাবিলার জন্য সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে। কোনো পার্টিকে সমর্থন, নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া এসব এই সংগঠনের গঠনতন্ত্রের সঙ্গে মিলবে না।’
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে আল্লামা শফীর ইন্তেকালের পর নতুন আমির হন মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী। তার কমিটিতে বিভিন্ন ইসলামি রাজনৈতিক দলের নেতারা পদ পান বলে অভিযোগ ওঠে। এতে সরকারবিরোধী অংশটি সরব হয়ে ওঠে। ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ঠেকাতে হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনে নামে। এতে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয় এবং বেশ কয়েকজন মারাও যান।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিজেদের কোনো যোগাযোগ নেই দাবি করে হেফাজতের এই নেতা বলেন, ‘রাজনৈতিক কোনো দলের সঙ্গে এই সংগঠনের সাংগঠনিক কোনো যোগাযোগ হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের যে ১৩ দফা দাবি ছিল সবগুলোই আমাদের প্রাণের দাবি। আমাদের এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- বড়রা যে সংগঠন বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিলেন সেই সংগঠনটাকে আবার সক্রিয় করা হয়েছে। এখন সংগঠনকে মজবুত করা, এর কার্যক্রমকে মজুবত করা। আমাদের সংগঠন মজবুতি অর্জন করলে আশা করছি আমাদের ১৩ দফা দাবি আদায়ের প্রত্যাশা পূরণ হবে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হেফাজতের আগের কমিটির এক নেতা বলেন, ‘হেফাজত এখন পুরোটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। মূলত এই কমিটিও হয়েছে সরকারের দেওয়া প্রেসক্রিপশনে। সরকারের আপত্তির কারণেই মাওলানা মামুনুল হককে কমিটিতে রাখা হয়নি। নতুন করে যত কর্মসূচিই দেওয়া হোক হেফাজত আর আগের সেই অবস্থান ও ইমেজ ফিরে পাবে না। কারণ সংগঠনের মূল নেতৃত্বের প্রতি আগের সেই আস্থা আর নেতাকর্মীদের নেই।’
ফিরে দেখা হেফাজতের উত্থান ও ঝিমিয়ে পড়া:
হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করে ২০১০ সালে। প্রতিষ্ঠার পরপর সরকারের প্রণীত নারী নীতিবিরোধী অবস্থানের কারণে আলোচিত হয় সংগঠনটি। তবে এর মূল উত্থান ঘটে ২০১৩ সালে। শাহবাগের গণজাগরণের মঞ্চকে নাস্তিকদের মঞ্চ আখ্যায়িত করে পাল্টা কর্মসূচি দেয় হেফাজত। ওই বছরের ৬ জুলাই রাজধানীর শাপলা চত্বরে লাখ লাখ লোকের গণজমায়েতের মাধ্যমে দেশে বিদেশে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় হেফাজত। ইসলামপন্থী দলগুলোর প্রায় সবাই এই হেফাজতের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে।
তবে এর ঠিক এক মাস পর ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ, শাপলা চত্বরে অবস্থানকে কেন্দ্র করে সরকারের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায় হেফাজত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে রাতে হেফাজতের নেতাকর্মীরা শাপলা চত্বর ছাড়তে বাধ্য হন। সেই অভিযানে নিজেদের কয়েকশ লোক হতাহত হয় বলে দাবি হেফাজতের।
দেশে নির্বাচন এলে বরাবরই কদর বাড়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর। বড় একটি জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করার কারণে হেফাজতে ইসলাম বিভিন্ন সময় গুরুত্ব পেয়ে আসছে। নির্বাচনের আগে স্বাভাবিকভাবেই তাদেরও কদর বেড়েছে। বিরোধী দলগুলো নিয়মিত হেফাজতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। আবার সরকারের সঙ্গেও হেফাজতের ‘বোঝাপড়া’ বেশ ভালো।
এই ঘটনার পর হেফাজত অনেকটা চুপসে যায়। তবে বছর তিনেক পরে কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে হেফাজতের তৎকালীন আমির আল্লামা শফীর। যা তার মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে আল্লামা শফীর ইন্তেকালের পর নতুন আমির হন মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী। তার কমিটিতে বিভিন্ন ইসলামি রাজনৈতিক দলের নেতারা পদ পান বলে অভিযোগ ওঠে। এতে সরকারবিরোধী অংশটি সরব হয়ে ওঠে। ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ঠেকাতে হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনে নামে। এতে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয় এবং বেশ কয়েকজন মারাও যান।
এই ঘটনার পর সরকার হেফাজতের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানে নামে। আলোচিত নেতা মাওলানা মামুনুল হকসহ অর্ধশতাধিক হেফাজত নেতা গ্রেফতার হন। এতে দ্বিতীয়বারের মতো চুপসে যায় হেফাজত। এক পর্যায়ে সরকারের চাপে কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালে হেফাজতের কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেই কমিটিতে বিতর্কিতদের বাদ দেওয়া হয়। তবে সেই কমিটি তেমন উত্তাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। এবার নতুন করে কমিটি সম্প্রসারণ করা হলো, যেখানে সারাদেশ থেকে দুই শতাধিক আলেমকে পদায়ন করা হয়েছে। আগের কমিটিতে বাদ পড়া কথিত বিতর্কিত অনেককে নতুন করে নেওয়া হয়েছে।