সারাবিশ্বে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি একটি স্বাভাবিক বিষয়। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় এই হার যেন বাংলাদেশে অনেকটাই বেশি। মানুষের আয় বা ক্রয়ক্ষমতা যদি বাড়ে তবে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি মেনে নিতে খুব একটা কষ্ট হয় না। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না মানুষের আয়। সীমিত আয়ের মানুষদের এখন ত্রাহি অবস্থা। ফলে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, এমনকি স্থির আয়ের মানুষের জীবন পড়েছে অনেকটা সংকটে।
যদিও স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করবে দেশ ২০২৬ সালে, তারপরও দেশে অনেক মানুষ রয়েছে দারিদ্র্য ও অতি দারিদ্র্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ-২০২২ এর তথ্যানুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা ১৮ দশমিক ৭ এবং অতি দারিদ্র্যের সংখ্যা দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া রয়েছে কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও নানা পেশার স্থির আয়ের মানুষ। দৈনিক, সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক আয় দিয়ে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে অনেকের। অসীম অভাবের মধ্যে কোন অভাবটি আগে পূরণ করবেন তা সিদ্ধান্ত নিতে হিমসিম খাচ্ছেন তারা। দৈনন্দিন জীবনের ভোগ ব্যয় কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন দারিদ্র্য, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও স্থির আয়ের মানুষ। কাঁটছাট করতে হচ্ছে সন্তানদের শিক্ষা ব্যয়সহ নানা আবদার। চাহিদা পূরণ করতে না পেরে দেখা দিচ্ছে পরিবারে অশান্তি। ধনীরা টের না পেলেও মূূল্য বৃৃৃদ্ধিতে দিশেহারা এসব মানুষ। মূল্যবৃদ্ধির এ প্রভাব গিয়ে পড়েছে সমাজেও। আর্থিক সংকট মোকাবেলায় অবৈধ উপার্জনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন অনেকেই। দামবৃদ্ধিকালীন ধনীরা আরো ধনী এবং গরীবরা আরো গরীব হয় বলে সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে আয় বৈষম্য। এক লাফে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে পরিবহন খাতসহ বিভিন্ন খাতে। প্রভাব পড়েছে গত বোরে মৌসুমে চাষ ও সেচ কার্যে। আকাশচুম্বী দাম বাড়িয়েছেন চাষ ও সেচ প্রদানে নিয়োজিত পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর ও সেচ পাম্প মালিকরা। মাঝে দুই-এক টাকা করে ডিজেলের দাম কমলেও সুফল মেলেনি তাতে।
রান্নার কাজে ব্যবহৃত এলপিজি সিলিন্ডারের দাম একবার কমলেও বেড়েছে আরেকবার। আবার দাম কমলেও নির্ধারিত দামে বাজারে মিলত না সেই সিলিন্ডার। মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি দামে কেনা বলে আগের দামেই কিনতে বাধ্য করতেন ভোক্তাদের। একই অবস্থা ছিল ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রেও। হিমাগারে ডিম মজুত করে দাম বাড়িয়ে দিতেও দেখা গেছে ব্যবসায়ীদের।
বাজারে যোগানের ঘাটতি নেই মাছ, মাংস, শাকসবজির, তবুও সকাল-বিকাল বেড়েছে দাম। বেড়েছে চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম। দাম বেড়েছে ওষুধেরও। আড়াই টাকার ওষুধ হয়েছে ৬ টাকা। মোদ্দা কথা, দাম বাড়েনি এমন পণ্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
কিন্তু এই যে মূল্য বৃদ্ধি, এর কারণ কী?
পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পিছনে রয়েছে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি এবং কিছু সংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ীর হাত। সিন্ডিকেট করে তারা অসাধু ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের স্বার্থ নয়, বরং নিজেদের হীন স্বার্থে দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছে। মজুতদার, কালোবাজারি, মুনাফাখোর, চোরাকারবারিরা অধিক লাভের আশায় দেশের অভ্যন্তরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর অবৈধভাবে মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দ্রব্যের দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। দ্রব্যের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ব্যবধান থাকলেও দাম বৃদ্ধি পায়। তবে যোগান স্বাভাবিক থাকলেও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে যোগানে ঘাটতি দেখিয়ে মূল্যবৃদ্ধি করে থাকে। যার প্রমাণ দেখা গেছে, ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানে হিমাগার থেকে লাখ লাখ ডিম বের হয়ে আসা, খাটের নিচ থেকে সয়াবিন তেল বের করার মতো ঘটনাগুলো। রয়েছে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব। অবৈধ আয় উপার্জনকারীদের ক্রয় ক্ষমতা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি যা প্রকারান্তরে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া রয়েছে নিয়মিত বাজার তদারকি ব্যবস্থায় ঘাটতি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্য পর্যালোচনা ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) নিজেদের উদ্যোগে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে করা সাম্প্রতিক এক জরিপ থেকে জানা যায়, খাদ্য মূল্যস্ফীতি চলতি বছর রেকর্ড ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির তথ্যমতে, দেশে গত পাঁচ বছরে শুধু ভোগ্যপণ্যের দাম ৩১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
মূল্য বৃদ্ধির এমন প্রবণতা থেকে বেড়িয়ে আসতে নজর দিতে হবে কৃষিতে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ, উন্নত বীজ, সার ও সেচের ব্যবস্থা করতে পারলে উৎপাদন বাড়বে ও দাম আয়ত্বের মধ্য থাকবে খাদ্যশস্যের। দাম কমবে অনেক সংশ্লিষ্ট পণ্যেরও। রক্ষা হবে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ভারসাম্য।ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণে ব্রাজিল, আর্জেনটিনা ও যুুুুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন এবং মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে পাম তেল আমদানি করতে হয়। তাই দাম নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। সময় এসেছে আমদানিকৃত সয়াবিন তেলের উপর নির্ভরতা কমিয়ে দিয়ে দেশে উৎপাদিত সরিষার তেলের উপর নির্ভরতা বাড়ানোর। এতে দেশের কৃষকেরা যেমন উপকৃত হবেন তেমনি সাশ্রয় হবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার। ব্যবসায়ীরা যাতে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো পণ্যের দাম বৃদ্ধি করতে না পারে সেদিকে নজরদারি জোরদার করা জরুরি। পাশাপাশি চোরাচালানকারীরা যাতে পণ্য পাচার এবং মজুতদাররা যাতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অধিক মুনাফা লুটতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।
সুতরাং পণ্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দারিদ্র্য, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও স্থির আয়ের মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণের কথা গুরুত্ব দিয়েই ভেবেে দেখা প্রয়োজন। তবে আশার কথা হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দাম বৃৃৃদ্ধির যাতাকলে পিষ্ট মানুষকে রক্ষা করতে নিয়েছেন নানা পদক্ষেপ। গত রোববার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের এক সভায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা চাপমুক্ত হতে চাই তোমাদের (শিক্ষার্থী) মাধ্যমে। তোমাদের হাতটা এত শক্তিশালী হয়েছে, আমার মনে হয় তোমরা যেখানে হাত দেবে সেখানেই সোনা ফলবে। আমরা আসলেই ব্যর্থ হয়েছি। আমরা এখন তোমাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি।’
আমরাও ডিজির বক্তব্যের প্রতি আস্থা রেখে তার বাস্তবায়ন দেখতে চাই। খেয়ে-পরে, চিন্তামুক্তভাবে যাতে বাঁচতে পারেন দারিদ্র্য, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও স্থির আয়ের মানুষ। রাষ্ট্রের নিকট এতটুকুই প্রত্যাশা।
লেখক: এম এ মাসুদ
সংবাদকর্মী ও কলাম লেখক
ই-মেইল: masud.org2018@gmail.com