আশরাফুল হক, লালমনিরহাট।। শুক্রবার (১৪ জুলাই) সকাল ৬ টা থেকে দুপুর পর্যন্ত দেশের বৃহত্তর সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের তিস্তা নদীর ডালিয়া ব্যারেজে বিপৎসীমার ৪০ সেঃ মিঃ ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নদীর বাম তীরের প্রায় ১৫ হাজার পরিবার পানি বন্ধি হয়েছে। পানি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায় আরো নতুন নতুন এলাকা বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে।
ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন পানিবন্দি এসব পরিবারের সদস্যরা। গবাদি পশু-পাখি আর মৎস্য খামারিরাও চরম বিপাকে পড়েছেন।
ব্যারেজ ও নদী তীরবর্তী মানুষ জানান, গত কয়েক দিনের থেমে থেমে ভারী বর্ষণ আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বেড়ে যায়। পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে তিস্তা ব্যারেজের লালমনিরহাট অংশের সব কটি জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। বুধবার রাত থেকে পানি বাড়তে থাকে। বৃহস্পতিবার সকাল ৬ টায় ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যা সকাল ৯ টা পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে। দুপুর ১২ টায় কিছুটা কমে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ২৮ মিটার। যা বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপরে। কিছু সময়ের ব্যবধানে সন্ধা ৬ পর বিপদ সীমার ৩৬ সেঃ মিঃ উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে এভাবে সময়ের ব্যবধানে শুক্রবার সকাল ৬ টা থেকে বিপদসীমার ৪০ সেঃ মিঃ ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানি প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় তিস্তার তীরবর্তী ও লালমনিরহাটের ৫ উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে এবং নতুন নতুন এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।
তিস্তা নদীর বাম তীরের জেলা লালমনিরহাটের ৫ টি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। সব কয়টি উপজেলার নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার। যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। পানি যত বাড়ছে নদী পাড়ের মানুষের আতঙ্ক ততই বাড়ছে। চরাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
পানিবন্দি পরিবারগুলোর মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। নদীপাড়ের অধিকাংশ পরিবারের সুপেয় পানির টিউবয়েল পানির নিচে ডুবে গেছে। পায়খানা ডুবে যাওয়ায় পুরুষরা বাহিরে যেতে পারলেও নারীরা প্রস্রাব পায়খানায় ব্যাপারে চরম বিপাকে পড়েছেন। মাচাং বানিয়ে তাতে রান্না করছেন নারীরা। এক বেলা রান্না করে চালিয়ে নিচ্ছেন ২/৩ বেলা। মাচাংয়ের ওপর পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিস্তা পাড়ের পানিবন্দি পরিবারগুলো। বন্যার কারণে এসব এলাকায় সাপসহ পোকা-মাকড়ের উপদ্রব বেড়েছে কয়েকগুন। ফলে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন এসব পরিবার।
মাচাংয়ের ওপর চুলা বসিয়ে দিন রাতের রান্না এক সঙ্গে করছেন গোবর্দ্ধন স্প্যার বাঁধ এলাকার গৃহবধূ দৌলতন নেছা (৫০) বলেন, বন্যা হলে কষ্ট বাড়ে। পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে মাচাংয়ে রান্না করতে হয়। পানিতে বেশিক্ষণ থাকলে নানান রোগ হয়। তবুও বাঁচতে হলে খাইতে হবে। দিন ও রাতের খাবার একবারে রান্না করতেছি। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এখন পর্যন্ত পাইনি। তাই ওই পানিই খাইতে হচ্ছে যোগ করেন দৌলতন নেছা।
সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ এলাকার পানি বন্ধি এজাজুল বলেন, রাত থেকে পানি বাড়ছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বিছানার নিচে পানি। মাচাং বানিয়ে কোনো রকম রান্না করা হচ্ছে। গবাদি পশুপাখি আর শিশু বৃদ্ধদের নিয়ে উঁচু স্থানে এসেছি। রাত হলে আবার মাচাংয়ের ওপরে বসে বসে রাত কাটাতে হবে। সাপের ভয়ে আর ছোট বাচ্চারা পানিতে পড়ে যাওয়ার ভয়ে রাত জেগে থাকতে হচ্ছে।
আদিতমারীর মহিষখোচা এলাকার মানজেদুল ইসলাম বলেন, নদীপাড়ের নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে। অনেক পুকুর ডুবে মাছ ভেসে গেছে। পুকুরের মাছ রক্ষায় চারদিকে নেট জাল দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করছি। তবে পানি আরও বাড়লে কয়েক লাখ টাকার মাছ ভেসে যাবে। পুকুরের মাছ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এ মৎস্য চাষি।
হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক শ্যামল ও পাটিকাপাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মজিবুল আলম সাহাদাত জানান, তাদের ইউনিয়নের অসংখ্য পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ক্রমে বাড়ছে পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন মহলকে অবগত করা হয়েছে বলেও জানান তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) তিস্তা ব্যারেজ ডালিয়া শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আসফা উদ দৌলা বলেন, বৃষ্টি আর উজানের ঢলে তিস্তার পানি প্রবাহ বেড়েছে। সবগুলো জলকপাট খুলে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৬ টা এবং সকাল ৯ টায় বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে। দুপুর ১২টায় মাত্র ৬ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সন্ধা ৬ টায় বিপদসীমার ৩৫ সেঃ মিঃ ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। টানা কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বিপদসীমার ৪০ সেঃ মিঃ ওপরে থাকায় তিস্তা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যা বলেন, তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে সকালে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জরুরি প্রয়োজনসহ যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুতি নেওয়া রয়েছে। আমরা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও ইউএনওদের মাধ্যমে সকল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।