রাশেদুল ইসলাম রিপন,স্টাফ রিপোর্টার: মাদারীপুরে চাকরী দেওয়ার কথা বলে চার বছর আগে প্রতিবন্ধী লুৎফর মুনসীর মেয়ে লাভলী আক্তার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েও চাকরি না দেয়ার অভিযোগ শেখ শহিদুল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে।
৫লক্ষ টাকার বেশি পেয়ে মর্জিনা নামে অন্য একজনকে নিয়োগ দেয়ার সংবাদ শুনে ৪ বছর ফ্রি সার্ভিস দেয়া লাবলী অসুস্থ্য হয়ে শনিবার সন্ধ্যায় মাদারীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। গত শনিবার (২৪ জুন) মাদারীপুর সদর উপজেলার শেখ শহিদুল উচ্চ বিদ্যালয়ের আয়া পদসহ বেশ কয়েকটি পদে নিয়োগ পরীক্ষা নেয়া হয়। এতে আয়া পদে লাভলীকে উত্তীর্ণ না দেখিয়ে ৫লক্ষ বেশী টাকা নিয়ে মর্জিনা নামে এক প্রার্থীকে পরিক্ষা উত্তীর্ণ দেখানোর অভিযোগ উঠেছে।
জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়ন ঝাউদি এলাকার শেখ শহিদুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয়ে কয়েকটি পদ খালী থাকায় একজন অফিস সহকারী, একজন পরিছন্ন কর্মি, একজন নাইট গার্ড ও একজন আয়া মোট চারটি পথে নিয়োগ পরিক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরিক্ষার আগে আয়া পদের ঘুসের আলোচনা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৪ বছর আগে থেকে ওই বিদ্যালয়ে আয়া পদে বিনা বেতনে কাজ করা লাভলী আক্তার ও তার বাবা লুৎফর মুনসী।
গত শনিবার(২৪ জুন) ডিডির প্রতিনিধি, মাদারীপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষা মন্ত্রালয়ের প্রতিনিধি মাদারীপুর সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসারের উপস্থিতে বিদ্যালয়ে চারটি পদের নিয়োগে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু অসাধু উপায়ে আয়া পদে এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ অসুস্থ্য লাভলী আক্তার।
লাবলীর পরিবার ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান ঘটমাঝি ইউনিয়নের পূর্ব চিরাইপারা গ্রামের ৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. লুৎফর মুন্সীর মেয়ে লাভলী আক্তারকে ২০১৮ সালে মার্চ মাসের দিকে স্কুলে আয়া পদে চাকুরি দেওয়ার কথা বলায় লাভলী জমিজমা বিক্রি করে প্রধান শিক্ষককে ৫ লাখ টাকা দেন। টাকা দেওয়ার পর থেকে দীর্ঘ চার বছর ধরে তিনি স্কুলে বিনা বেতনে কাজ করে আসছিলেন। এদিকে ঝাউদি ইউনিয়নের গুহাতলা গ্রামের ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা নিজাম শিকদারের মেয়ে মর্জিনা আক্তার (প্রার্থীর) কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে লাভলী আক্তারকে নিয়োগ পরীক্ষা থেকে বাদ দিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠে। আর এই চাকরি না পেয়ে মানষিক ভাবে অসুস্থ্য হয়ে বার বার জ্ঞান হারিয়ে যাওয়ায় লাভলীকে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়।
মাদারীপুর সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. সাইফ আহমেদ জানান, এই রোগী শারিরিক দুর্ভলতা ও মানষিক ভাবে চিন্তাগ্রস্থ মনে হচ্ছে, তার পরিবারের কাছ থেকে যা জানতে পারলাম। আর এই কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। আমার হাসপতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা নেয়ার ব্যবস্থা করেছি।
স্থানীয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, অযোগ্য এক লোককে চাকরি দেওয়া হয়েছে। লাভলী প্রার্থী পরীক্ষায় পাস না করলে আমাদের অভিযোগ নাই। কিন্তু সে তো পরীক্ষায় পাস করছে। যে পাস না করছে তাকে চাকরি দিয়েছে মোটা অংকের বিনিময়। লাভলী আক্তার দীর্ঘ বছর ধরে এখানে বেতন ছাড়া কাজ করতেছে। সে চাকরির জন্য হেডমাস্টারকে ৫ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছে। হেডমাস্টার তার কাছে আরো দুই লক্ষ টাকা দাবি করছে সে দিতে নারাজ হওয়ায়। অন্য একজনের থেকে বেশি টাকা নিয়ে তাকে চাকরি থেকে বাদ দিয়েছে। আমরা হেডমাস্টারের বিচার চাই।
চাকরি প্রত্যাশী লাভলী আক্তার বলেন, দীর্ঘ ছয় বছর আগে তার বাবা লুৎফর মুনসী স্টোক করে শারিরীক প্রতিবন্ধী হয়ে পরেন। সেসময় সংসার চালানোর কেউ ছিল না তাদের। আমিই সংসারের হাল ধরি। এদিকে মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসারে জোগান দেন। চার বছর আগে আমাকে তার স্কুলে আয়া পদে চাকরির দেওয়ার কথা বলায় আমি আমি ঋণ, জমিজমা ও ভিটামাটি বিক্রি করে পাঁচ লক্ষ টাকা লুৎফর রহমান স্যারকে দেই। সে মর্জিনা নামের এক প্রার্থীর কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে আমাকে তারা পরীক্ষায় ফেল দেখাইছে।
এদিকে চার বছর আগের থেকে আমি ওই বিদ্যালয়ে কাজ করে আসছি এবং হেডমাস্টার আমার চাকরি দেওয়ার কথা বলে আমার প্রতিবন্ধী বাবাকে দিয়েও নাইট গার্ডেরও কাজ করাইছে। আমরা চার বোন আমাদের কোন ভাই নাই। আমরা নিজেরাই সব কষ্ট-মষ্ট করে সংসার চালাই। চাকরি না পেলে আমি বেঁচে থেকে আর কি লাভ হবে। আমি সরকার এবং প্রশাসনের কাছে আমি আমার চাকরি ফেরত চাই। এবং মাস্টারের শাস্তি চাই।
লাভলী আক্তারের মা রেবেকা বেগম বলেন, চাকরি পাওয়ার জন্য বিনা বেতনে আমার মেয়ে এই আয়ার কাজ করেছে। এই কয় বছওে আমার অনেক দেনা হয়ে গেছি। এদিকে ঘরে া অসুস্থ্য স্বামী চিকিৎসা টাকা জোগার করতে না পেরে এখন তিনি প্রতিবন্ধী হয়েছে। সংসার সবাইকে নিয়ে আমি আমরা খুবই অসহায় অবস্থায় আছি। আমার মেয়ের চাকরিটা হলে হয়তো সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতাম।
লাভলী আক্তারের প্রতিবন্ধী বাবা লুৎফর মুন্সি বলেন, আমার মেয়েকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ৫ লাখ টাকা নিয়েছে হেড মাস্টার লুৎফর রহমান। এবং আমাকে বলছে তোমার মেয়েকে চাকরি দিব তুমি স্কুলে নাইটগার্ডের কাজ করো। আমি আমার মেয়ের জন্য চাকরির জন্য আমি অসুস্থ শরীর নিয়ে সারারাত স্কুল পাহারা দিছি। আজকে অন্যের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে আমার মেয়েকে চাকরি থেকে বাদ দিয়েছে। আমি হেডমাস্টারের বিচার চাই।
এবিষয় প্রধান শিক্ষক লুৎফুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ওই মেয়ে পরীক্ষায় পাস না করায় আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। আমি লাভলীর কাছ থেকে কোন টাকা নেই নাই। এবং সে দীর্ঘ চার বছর ধরে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেছে এটা সত্য।
এবিষয় যারা নিয়োগ পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের সবার সাথে যোগাযোগ করা চেস্টা করেও তাদের কারো কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
শেখ শহিদুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. ইলিয়াস হোসাইন হাওলাদার বলেন, বৈধ ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। পরিক্ষার সবাই উপস্থিত ছিলেন। নিয়োগ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়েছে তাদেরকেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। হেড মাস্টার যদি কোন প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকে। সেই প্রার্থী যদি অভিযোগ করে তাহলে তদন্ত করে প্রামানিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাদারীপুর সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোফাজ্জল হোসেন জানান, পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগে যদি অনিয়ম হয় অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
মাদারীপুর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হাবিব উল্লাহ খান বলেন, চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়া অপরাধ। প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।