তাহমিনা আক্তার, ঢাকা:: দেশের কারাগারগুলোর অভিন্ন স্লোগান-‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’। কিন্তু কিছু কারাগারে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। ‘নিরাপদ’ জায়গাতেও ঝুঁকিতে পড়ছেন বন্দিরা।
কারা অভ্যন্তরে বন্দি নির্যাতনের ঘটনা মাঝেমধ্যেই সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। বন্দিদের মধ্যে মারামারিও হচ্ছে। অসাধু কারা কর্মকর্তার কারণে অনিরাপদ বোধ করেন সাক্ষাৎপ্রার্থী স্বজনরাও। অন্যদিকে ‘আলোর পথ’ও অন্ধকারে ঢাকা পড়ছে। কিছু বন্দি অন্ধকারের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছেন।
কারা অভ্যন্তরে মাদক প্রবেশের অভিযোগ অনেক পুরোনো। অন্ধকার জগতে প্রবেশের সুযোগ থাকায় অপরাধীদের অনেকেই কারাগার থেকে বের হয়ে ফের যোগ দিচ্ছেন নানা অপরাধ তৎপরতায়। খুনসহ বিভিন্ন অপরাধের পরিকল্পনা হচ্ছে কারাগারে। কারাগারে বসে জঙ্গিরা সংগঠিত হয় বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, কম্বল গায়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে ৩ আগস্ট গভীর রাতে কারা অভ্যন্তরে জাফর এবং রফিক ছালাম নামে দুই রোহিঙ্গার মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। পরদিন জাফরের মৃত্যু হয়। কারা অভ্যন্তরে নির্যাতনের কারণে জাফরের মৃত্যু হয়েছে বলে স্বজনরা অভিযোগ করলেও ময়নাতদন্তের রিপোর্টে এর সত্যতা মেলেনি।
এ বিষয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার জেলা কারাগারের জেলার শওকত হোসেন মিয়া যুগান্তরকে বলেন, দুই বন্দির মারামারির ঘটনায় কারাসংশ্লিষ্ট যেসব ব্যক্তির দায়িত্বে অবহেলা ছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আর কারাবন্দি রফিক ছালামকে সতর্ক করা হয়েছে।
সম্প্রতি কারা মহাপরিদর্শকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন সুমাইয়া আক্তার (২৪) নামের এক সাক্ষাৎপ্রার্থী। তিনি জানান, তার স্বামী মামুনুর রশিদ ঝালকাঠি কারাগারে বন্দি। স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে জেলার আক্তার হোসেন শেখের সহযোগিতা চান। বিনিময়ে সুমাইয়াকে কুপ্রস্তাব দেন আক্তার।
অভিযোগে বলা হয়, গত ২৯ জুলাই থেকে মামুনুর রশিদ কারাগারে আছেন। গত ৩০ জুলাই স্বামীর সাথে দেখা করতে সুমাইয়া ঝালকাঠির জেলারের সহকারীর নম্বরে ফোন করেন। ওই সহকারী দেখা করিয়ে দিতে না পারলেও কারাবন্দি স্বামীর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেন। পরে জেলার আক্তার হোসেন সুমাইয়ার মোবাইল নম্বর রেখে দেন।
এরপর থেকে সুমাইয়ার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে নিয়মিত কথা বলেন জেলার। স্বামীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে নানারকম অশ্লীল ও অনৈতিক প্রস্তাব দেন। তার প্রস্তাবে রাজি না হলে তাকে কারাবন্দি স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ বন্ধ করে দেবেন। কারাগারে স্বামী মামুনের নানা সমস্যা হবে বলেও ভয়ভীতি দেখান।
এ ব্যাপারে ঝালকাঠির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেল সুপার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মিলন চাকমা যুগান্তরকে বলেন, জেলারের বিরুদ্ধে যেখানে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে সেখান থেকে তদন্ত হচ্ছে। এ ছাড়া অভিযোগের বিষয়টি যেহেতু আমি অবগত, তাই আমার অবস্থান থেকেও তদন্ত করছি।
গত ১ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে গাঁজা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রবেশকালে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চালক ও এক পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারের মূল ফটকে তল্লাশি না করেই ট্রাকটিকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার লুৎফর রহমান যুগান্তরকে বলেন, কারাগারে অস্ত্র ও মাদকসহ ট্রাক প্রবেশচেষ্টার ঘটনায় কোনো কারারক্ষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কারণ, এটা দায়িত্বরত কারারক্ষীদের ব্যর্থতা নয়, সফলতা। ট্রাকটি মূল ফটক অতিক্রম করলেও কারা অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারেনি। এর আগেই তল্লাশির সময় ধরা পড়েছে।
কোনাবাড়ী থানার ওসি কেএম আশরাফ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, গ্রেফতাররা মূলত সিটি করপোরেশনের কর্মচারী। তারা সিটি করপোরেশনের কাজের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে কারা অভ্যন্তরে মাদক সরবরাহ করছিলেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে তাদের রিমান্ড চাওয়া হয়েছিল। আদালত রিমান্ড মঞ্জুর না করে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তারা এখন জেলহাজতে আছেন।
অফিসে বসে মাদক সেবন, বন্দি বেচাকেনা, সাক্ষাৎ-বাণিজ্য, ভুয়া বিল বানিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ, চিকিৎসা-বাণিজ্য ও খাবার পরিবেশনে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ ভোলা জেলা কারাগারের কারা সহকারী সাইদুজ্জামান সুমনের বিরুদ্ধে।
এক নারী কারারক্ষীর কাছ থেকে ঘুস আদায় করেছেন তিনি। মাদক সেবন করে নারী কারারক্ষীকে গালাগাল করেছেন। দিয়েছেন হুমকিও। এসব অভিযোগে ওই নারী কারা মহাপরিদর্শকের কাছে সুমনের বিরুদ্ধে লিখিত দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে শুক্রবার রাতে ভোলা জেলা কারাগারের জেল সুপার রিপন কুমার সাহা মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে জানান, সাইদুজ্জামান সুমনের বিরুদ্ধে একাধিক তদন্ত কমিটি তদন্ত করেছে। কমিটিগুলো কারা অধিদপ্তরে প্রতিবেদন জনা দিয়েছে। অধিদপ্তর থেকে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। সিদ্ধান্ত এলে সে অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যুগান্তরের গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধা জেলা কারাগারে রাতভর চলে লাখ টাকার জুয়া। টাকা হলে সব মেলে এই কারাগারে। কারাগারে বন্দিদের কাছে নগদ টাকা রাখা নিষিদ্ধ হলেও পুলিশের হাত হয়ে টাকা চলে যায় বন্দিদের কাছে। বন্দিদের ভাত দেওয়া হলেও দেওয়া হয় না তরকারি। বাধ্য করা হয় মেস থেকে তিনশ টাকায় এক বাটি তরকারি কিনতে। কারাগারের এই সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন দাগি আসামি আর কারা কর্তারাই। সরকারি টাকা ভুয়া বিল করে আত্মসাৎ করা হয় এখানে।
এ বিষয়ে গাইবান্ধা জেলা কারাগারের জেল সুপার নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আপনি যেসব অভিযোগের কথা বলছেন সেগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত হয়েছে। তদন্তে কোনো অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কারারক্ষী নিয়োগে ভয়াবহ জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। একজনের নামে অন্যকে দিয়ে চাকরি করানোর ঘটনাও ঘটেছে। প্রকৃত নাম কামাল হোসেন। ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার নাটিমা ইউনিয়নের উজ্জলপুর গ্রামে বাড়ি তার। কিন্তু গত সাত বছর ধরে মো. আরমান হোসেন সেজে কারারক্ষী হিসাবে চাকরি করছিলেন এই ব্যক্তি।
কারাগারের ৪২৭১৯নং কারারক্ষী হিসাবে সবশেষ কর্মরত ছিলেন কুষ্টিয়া জেলা কারাগারে। জালিয়াতির মাধ্যমে তার বাবার নাম সিদ্দিকুর রহমান ও ঠিকানা শংকুরপুর বাস টার্মিনাল, চাচড়া, যশোর-দেখিয়ে চাকরি করছিলেন তিনি।
এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের জেল সুপার আব্দুল বারেক জানান, ভুয়া নাম ঠিকানা দিয়ে চাকরি করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আরমান হোসেন পরিচয়ধারী কামাল হোসেনকে এরই মধ্যে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সাবরুল বাজারে গত চার বছরে চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এসবের নেপথ্যে জনৈক সাগর হোসেন তালুকদারের (৩৩) নাম বেরিয়ে এসেছে। হত্যাসহ একডজন মামলার আসামি সাগর বর্তমানে কারাগারে। গত ২ সেপ্টেম্বর সাবরুল বাজার থেকে মোটরসাইকেলে বগুড়া শহরে যাওয়ার পথে মাথাইলচাপড় এলাকায় কলেজশিক্ষক ও আওয়ামী লীগের নেতা শাহজালাল তালুকদার ওরফে পারভেজকে (৪৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
সাগরের পরিকল্পনাতেই এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। নিহতের পারিবারিক সূত্র জানায়, সাগরের বিরুদ্ধে বিচারাধীন একটি হত্যা মামলায় ভাই নুরুজ্জামান তালুকদার সাক্ষী হওয়ায় পুরো পরিবারের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন সাগর। এ কারণে আত্মসমর্পণ করে কারাগার থেকে হত্যার ছক আঁকেন সাগর। পরিকল্পনা অনুযায়ী, কারাগার থেকে কলকাঠি নেড়ে ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দিয়ে শাহজালালকে হত্যা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে শাজাহানপুর থানার ওসি শহিদুল ইসলাম বলেন, সাগর কারাগারে অবস্থান করে কলেজশিক্ষক শাহজালালকে হত্যার ছক এঁকেছেন বলে অভিযোগ এসেছে। আমরা এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।