আশরাফুল হক, লালমনিরহাট: এক পরিবারে স্বামী স্ত্রী দুই জনের নামে খাদ্যবান্ধব কর্মসুচির কার্ড থাকলেও ৮ বছরে এক ছটাক চালও মিলেনি দিনমজুর মমিনুর ছকিনা দম্পতির ভাগ্যে।
বুধবার(২৭ মার্চ) দীর্ঘ ৮ বছরের চাল আত্নসাৎকারী ডিলারের শাস্তির দাবি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী দিনমজুর মমিনুর ইসলাম। মনিনুর ইসলাম লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের মহিষাশ্বর ম্যালম্যালির বাজার এলাকার মৃত আব্দুস সামাদের ছেলে।
জানা গেছে, হতদরিদ্র শ্রমিক দিনমজুর পরিবারের মানুষদের মাঝে অল্প মুল্যে চাল বিক্রি করতে সরকার খাদ্য বান্ধব কর্মসুচি চালু করে। প্রথম দিকে ভর্তুকী মুল্যে ১০ টাকা কেজি দরে পরিবার প্রতি ৩০ কেজি হারে চাল বিক্রি শুরু করে সরকার। পরবর্তিতে দাম বাড়িয়ে ১৫টাকা কেজি দর করা হয়। যা কর্মহীন সময় অর্থাৎ মার্চ, এপ্রিল, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে এসব চাল কার্ডধারীদের মাঝে নির্ধারীত ডিলারদের মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রথম দিকে কার্ডধারীরা খাদ্যবিভাগের কার্ড প্রদর্শন করে চাল ক্রয় করতে পারতেন। যা নিয়ে নানান অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর বেড়িয়ে আসলে সরকার সুফল ভোগীদের তথ্য ডিজিটাল করে ফেলেন। অভিযোগ উঠেছে, উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের খাদ্যবান্ধব কর্মসুচির ডিলার এনামুল হক ভরসা চালের কার্ড করে দেয়ার কথা বলে ২০১৬ সালে দিনমজুর মমিনুর ইসলামের কাছ থেকে তার নিজের ও তার মায়ের পরিচয়পত্রের ফটোকপি সংগ্রহ করেন। পরিচয় পত্র নিয়ে উপজেলা খাদ্য অফিস থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসুচির কার্ড করলেও তা মমিনুর ইসলামকে দেননি।
গত ১৮ সালে মমিনুর ইসলামের মা রশিদা বেগম মারা গেলেও তার নামে বরাদ্ধের চাল উত্তোলন করে আত্নসাৎ করেন ডিলার এনামুল হক ভরসা। অপর দিকে গেল বছর সরকার কার্ডধারীদের তথ্য ডিজিটাল করায় বিপাকে পড়েন ডিলার এনামুল হক ভরসা। কারন, কার্ডধারীর আপডেট ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ লাগবে। তখন কৌশলে ডিলার এনামুল হক ভরসা মৃত কার্ডধারী রশিদার পুত্রবধু ছকিনার নামে কার্ড করে দেয়ার কথা বলে ছকিনার ও তার স্বামী মমিনুর ইসলামের ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করেন। এরপর মৃত রশিদার স্থলে তার পুত্রবধূ ছকিনার নামে কার্ড তৈরী করেন ডিলার ভরসা। একই সাথে দিনমজুর মমিনুর ইসলামের নামে কার্ডেও তথ্য ডিজিটালে হালনাগাদ করে কার্ড দুটি নিজের কাছেই রেখে দেন ডিলার এনামুল হক ভরসা। স্ত্রী ছকিনার নামের কার্ডটির জন্য দীর্ঘ দিন ধরে দিনমজুর মমিনুর নিস্ফল ঘুরেছেন ডিলারের দুয়ারে। খাদ্য সংকটে পড়ায় একপর্যায়ে অভাবি দিনমজুর মমিনুর ইসলাম ডিলারের হাতে পায়ে ধরেও কার্ডটি নিতে পারেননি। ডিলার সাব জানায় কোন কার্ডই অনুমোদন হয়নি। গত মাসের চাল বিতরন কালে উপজেলা খাদ্য বিভাগ ডিলারদের মাঝে কার্ডধারীদের তালিকা নতুন করে বন্টন করেন। এতে শফিকুল ইসলাম নামে এক ডিলারের হাতে পড়ে মমিনুরের স্ত্রী ছকিনার নামের কার্ড। সেই কার্ডে চাল নিতে আসেন ডিলার এনামুল হক ভরসার দোকানের কর্মচারী নাইম। এতে সন্দেহ হওয়ায় ছকিনা বেগমকে ফোন করেন নতুন ডিলার শফিকুল ইসলাম। তখন মমিনুরের পরিবার জানতে পারেন ছকিনার নামে খাদ্যবান্ধবের কার্ড হয়েছে। কার্ড হয়েছে মর্মে স্বীকার করলেও ৫হাজার টাকা না দিলে কার্ড দিবে না বলে সাব জানায় ডিলার এনামুল হক ভরসা।
নিরুপায় দিনমজুর মমিনুর ইসলাম অল্প দামে চাল পেতে ডিলার ভরসাকে ঋনে নেয়া ২হাজার টাকা দেন কার্ডটি ফেরত পেতে। টাকা নিলেও কার্ড বা চাল কোনটাই দেননি ভরসা। উপজেলা খাদ্য অফিসে গিয়েও কোন কর্মকর্তা কর্মচারী দিনমজুর মমিনুরকে সহায়তা করেননি। বরংচ ডিলার ভরসার বিরুদ্ধে না গিয়ে ভরসার কথামত চলতে বলা হয়। পরে অন্য মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন খাদ্যবান্ধব কর্মসুচির চালুর দিন হতে দিনমজুর মমিনুর ইসলামের নামে কার্ড ও চাল বরাদ্ধ ছিল। যার কার্ড নং - ১৬৯ এবং তার মৃত মা রশিদার পরিবর্তে তার স্ত্রী ছকিনার কার্ড নং ১৪৮০ নামেও কার্ড চাল বরাদ্ধ ছিল। পরিবারে দুইটি কার্ড থাকার পরেও এক ছটাক চাল কিনতে পারেননি দিনমজুর মমিনুর ইসলাম ছকিনা দম্পতি।
অবশেষে বুধবার(২৭ মার্চ) তাদের নামে বরাদ্ধকৃত খাদ্যবান্ধব কর্মসুচির কার্ড ও দীর্ঘ দিন ধরে আত্নসাৎ করা চাল উদ্ধার এবং অভিযুক্ত ডিলার এনামুল হক ভরসার বিরুদ্ধে বিচার দাবি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন মমিনুর ইসলাম।
ভুক্তভোগী মমিনুর ইসলাম বলেন, অভাবের সংসারে চাল ক্রয় করাই বড় কাজ। সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে ডিলার ভরসার হাতে পায়ে ধরে কার্ডটা চেয়েছিলাম। তিনি শুধু বলতেন অফিস অনুমোদন দিলে হবে। এখন জানতে পারলাম এ কর্মসুচি চালু থেকে আমার পরিবারের দুইটি কার্ড থাকার পরেও আমি এক ছটাক চাল কিনতে পারি নি। ভরসার আমার পরিবারের মুখের খাবার কেড়ে নিয়ে আত্নসাৎ করেছেন তার বিচার চাই।
অভিযুক্ত ডিলার এনামুল হক ভরসা বলেন, তার মা মারা যাবার পর তার স্ত্রীর নামে কার্ড হয়েছে। সেই কার্ডের চাল তুলে তার বাড়িতে পাঠাইতে গিয়েছিল আমার দোকানের কর্মচারী। কিন্তু চাল না পাওয়ায় তা হয়নি। আর তার নামেও কার্ড ছিল। যা সে জানত এবং প্রতি টিপে চাল তুলে নিতো। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ করা হয়েছে।
আদিতমারী উপজেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক হাসনা আখতার বলেন, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ তালিকা অনুমোদন করে পাঠালে আমরা কার্ড প্রস্তুত করে চাল বরাদ্ধ দিয়ে থাকি। এরপর ডিলারদের মাধ্যমে বিক্রির মাস্টারোল সংগ্রহ করি। ডিলার চাল কাকে দিলো তা দেখার সুযোগ নেই। কোন কার্ডধারী কবে থেকে সুফলভোগী হয়েছেন তার কোন তথ্যই আমার কাছে নেই। এমন নিউজ করলে উপজেলার দুর্নাম হবে। তাই নিউজ না করে আসেন ডিলারের সাথে আপোষ করে দিবো।
আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) নূর ই আলম সিদ্দিকী বলেন, দিনমজুরের সাথে এমন প্রতারনা করে চাল আত্নসাৎ খুবই দুঃখজনক। অভিযোগ পেয়েছি, তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।