সমগ্র মানবজাতি একই পিতা–মাতার সন্তান। সৃষ্টিতে ও মৌলিক গুণাবলিতে মানুষ যেসব অধিকার ধারণ করে, তাই মানবাধিকার বা মানুষের মৌলিক অধিকার। মানবাধিকারের প্রাথমিক বিষয়গুলো হলো স্বাভাবিক জন্মের অধিকার; বেঁচে থাকার অধিকার বা স্বাভাবিক জীবনধারণের অধিকার; মৌলিক প্রয়োজনীয় বস্তু ও বিষয় তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ নিরাপদ জীবনযাপন ও উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনের অধিকার; সম্মানজনক জীবন ও স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার। এসব অধিকার মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাআলাই মানুষকে দিয়েছেন। ইসলাম প্রকৃতির অনুকূল ও মানবিক ধর্ম। তাই সব মানুষ জন্মগতভাবেই এসব অধিকার লাভ করে থাকে।
ইসলাম সব মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, পিতা-মাতা, ভাইবোন, আত্মীয়-অনাত্মীয়, নারী-পুরুষ, শিশু–বৃদ্ধ, ধনী–গরিব, জাতি ও ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানবসন্তানই মানবাধিকারে সম অধিকারী। মানুষের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্যই আল্লাহ তাআলা অসংখ্য নবী–রাসুল পাঠিয়েছেন, অনেক কিতাব নাজিল করেছেন; শরিয়তের বিধান দিয়েছেন।
ইসলামি শরিয়তের বিধানে মানবাধিকারসংক্রান্ত পাঁচটি প্রধান ধারা নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা: জীবন রক্ষা, সম্পদ রক্ষা, বংশ রক্ষা, জ্ঞান রক্ষা ও ধর্ম রক্ষা। মূলত মানবতার সুরক্ষা বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাই ইসলামের মূল লক্ষ্য এবং মুখ্য উদ্দেশ্য।
বিজ্ঞাপন
ইসলামের শিক্ষা হলো সব মানুষ একই উপাদানে তৈরি, সবাই এক আল্লাহর বান্দা। সব মানুষ একই পিতা–মাতার সন্তান; সব মানুষ একই রক্তে–মাংসে গড়া; তাই সাদা–কালোতে কোনো প্রভেদ নেই
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) মানবতার মুক্তির বার্তা নিয়েই এ জগতে এসেছিলেন। তিনিই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা অন্ধকার ও অজ্ঞানতার যুগে পাপাচার, যুদ্ধবিগ্রহ, সহিংসতা, শিশুহত্যা ও কন্যাশিশুকে জীবন্ত মাটিচাপা দেওয়ার মতো অমানবিক প্রথার প্রচলন ছিল। ইসলামই কোরআন–সুন্নাহর বিধানে মানবতাবিরোধী সব কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধকে ‘কবিরা গুনাহ’ বা মহাপাপ রূপে আখ্যায়িত করেছে এবং এর জন্য দুনিয়ায় চরম শাস্তি ও পরকালে কঠিন আজাবের ঘোষণা দিয়েছে।
ইসলামের শিক্ষা হলো সব মানুষ একই উপাদানে তৈরি, সবাই এক আল্লাহর বান্দা। সব মানুষ একই পিতা–মাতার সন্তান; সব মানুষ একই রক্তে–মাংসে গড়া; তাই সাদা–কালোতে কোনো প্রভেদ নেই। সব মানুষ আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর উম্মত। কবরে ও হাশরে সবাইকে একই প্রশ্ন করা হবে। ইসলাম ইবাদতে যেমন নারী ও পুরুষকে সমমর্যাদা দিয়েছে, সম্পদের দিয়েছে যথার্থ অধিকার। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তাদের নারীদের জন্যও রয়েছে অধিকার, যেরূপ রয়েছে তাদের কর্তব্য।’ (সুরা: ২ বাকারা, আয়াত: ২২৮)।
কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এই কারণেই বনি ইসরাইলের প্রতি আমি এই বিধান দিলাম যে নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করা; হেতু ব্যতীত কেহ কাহাকেও হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল, আর কেহ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।’ (সুরা-৫ মায়িদাহ, আয়াত: ২৭)।
কোরআন কারিমের বাণী
‘আল্লাহ তাআলা (সৃষ্টিতে ও গুণাবলিতে) তোমাদের একের ওপর অন্যের যে প্রাধান্য দিয়েছেন তা দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব জাহির কোরো না। প্রত্যেক পুরুষ তাই পাবে, যা সে অর্জন করে এবং প্রত্যেক নারী তা পাবে যা সে অর্জন করে। আর তোমরা আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সকল বিষয়ে অবগত আছেন।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ৩২)। শিক্ষায়ও নারী-পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ইলম শিক্ষা করা সকল নারী ও পুরুষের ওপর ফরজ কর্তব্য।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)।
শাস্তি বিধানের ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব অপরাধীর সমান শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে। যেমন: ‘তস্কর পুরুষ ও তস্কর নারী, তোমরা তাদের উভয়ের হস্ত কর্তন করে দাও। এ হলো তারা যা অর্জন করেছে তার পরিণাম, আল্লাহর পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আল্লাহ তাআলা পরাক্রমশালী স্নেহশীল মহা কৌশলী।’ (সুরা-৫ মায়িদাহ, আয়াত: ৩৮)। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা সৎ কর্ম করবে তারা পুরুষ হোক বা নারী হোক, যদি তারা বিশ্বাসী হয় তবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারা সেথায় বেহিসাব রিজিক পাবে।’ (সুরা-৪০ মুমিন, আয়াত: ৪০)।
ইসলাম প্রতিষ্ঠা মানে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। নারী ও শিশু বিশেষত কন্যাশিশু এবং অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মানবাধিকার সুরক্ষা করা সামর্থ্যবান সব নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব এবং সব মুসলমানের ইমানি কর্তব্য।