রাশেদুল ইসলাম রাশেদ, স্টাফ রিপোর্টার: দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও এখনও মানুষ কেনা-বেচার হাট বসে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে । ভোর বেলা থেকে মানুষ আসা শুরু করে এ হাটে, অপেক্ষায় থাকে নিজেকে বিক্রির জন্য। ক্রেতা এসে পছন্দ ও দরদাম করে নিয়ে যায় তাদের।
মঙ্গলবার (২৩ মে), তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। বৃষ্টি পড়ছে গুঁড়ি গুঁড়ি। সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের তিস্তা বাজার মোড়ে শুরু হয়েছে মানুষের আনাগোনা। কেউ আসছেন বাইসাইকেলযোগে, কেউবা হেঁটে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা এসব মানুষের কারও কাছে কোদাল, কেউবা এনেছেন পাসুন বা নিড়ানি, কারও কাছে ডালি কিংবা কারও হাতে কাস্তে। এই মোড়কে ঘিরে আলাদা আলাদা দলবেঁধে বসে থাকা মানুষগুলো অপেক্ষা করছে ক্রেতা বা খরিদ্দারের।
খরিদদার এসে পছন্দ মতো লোক, সংখ্যা ও দাম বললে নির্দিষ্ট একটা কাজ বা পুরো দিনের জন্য নিজেকে বিক্রি করে দেবে এই মানুষগুলো। আর এভাবে বিক্রি করতে পারলে তবেই হবে তাদের পরিবারের খাওয়া-পাড়ার ব্যবস্থা হয়।
প্রায় এক যুগ ধরে প্রতিদিন ভোরে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তিস্তা বাজার মোড়ে বসে নামহীন শ্রমজীবীদের এ হাট। চলে সকাল ৯টা পর্যন্ত। কৃষি ও ভবন নির্মাণশ্রমিকেরা আসেন এখানে। দিন চুক্তিতে তাঁদের কিনতে আসেন হরিপুর, শ্রীপুর, কাপাসিয়া, বেলকা, তারাপুর, দহবন্দসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থরা। দরদাম ঠিক হওয়ামাত্র শ্রমিকেরা রওনা হন মালিকের কাজে। দিন শেষে মজুরি বুঝে পেলে এখান দিয়েই ফেরেন বাড়ি। সঙ্গে কিছু টাকা এবং সদাই। এরপর আরও একটি ভোরের অপেক্ষা। তারপর আবারও কোনো এক ‘মালিকে’র ফরমাশমতো কাজ করতে কোনো এক গ্রামে উপস্থিত হওয়া।
সরেজমিনে গিয়ে হাটের ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায়, এক শ্রমিক হ্যান্ডশেইকের জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘মামা কামলা লাগবে? কত দিবেন?’ বাড়ানো হাত ধরেই সাংবাদিক পরিচয়ে কথা হয় তার সাথে। নাম দুলাল মিয়া (৩০)। উপজেলার দহবন্দ ইউনিয়নের আরাজি দহবন্দ গ্রাম থেকে সেখানে এসেছেন তিনি। বৃষ্টিমুখর ভোরে দুলাল জানালেন, সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় খরচের ব্যাগ হাতে ধরিয়ে দিয়েছে বড় মেয়ে। কী কী বাজার করতে হবে, তা-ও বলে দিয়েছে। ভোরের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে প্রায় আধভেজা দুলাল মিয়া বললেন, ‘বড়রা লবণ–মরিচ দিয়েই ভাত খেয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু বাচ্চারা তো সেটা পারে না। তাদের জন্য কোনো না কোনো তরকারি লাগেই।’ ফলে এখন তিস্তা বাজার থেকে বৃষ্টির কারণে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। অথচ এই বৃষ্টিতে কাজ না পেলে খালি ব্যাগ নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হবে তাঁকে। সে জন্য এই তিস্তা বাজার মোড়ে তাঁর বিক্রি হওয়াটা জরুরি।
দুলাল মিয়ার মতো শ্রমিক মো. নুর আললি মিয়া (৪০)। তিনি এসেছেন সোনারায় ইউনিয়ন থেকে। পাঁচ সদস্যের সংসার তাঁর। বড় ছেলে সুন্দরগঞ্জ আবদুল মজিদ মণ্ডল উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এই তিস্তা বাজার মোড়ে নিজেকে বিক্রি করতে না পারলে হাতে টাকা আসবে না। আর টাকা না এলে খাওয়াদাওয়া সব বন্ধ হয়ে যাবে পুরো পরিবারের। তা ছাড়া, আছে ছেলের পড়াশোনার খরচ। সে কারণে এখানে নিজেকে বিক্রি করতে পারাটাই জিতে যাওয়া।
মো. জমির উদ্দিন (৫৩) এখানে এসেছেন শ্রমিক কিনতে। তাঁর বাড়ি বেলকা ইউনিয়নে। ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন বলে গ্রাম ঘুরে কাজ করার লোক খোঁজার সময় হয় না তাঁর। অনেক সময় খুঁজলেও পাওয়া যায় না। তিস্তা বাজার মোড়ে এলে যেকোনো ধরনের কাজের লোক পাওয়া যায়। এ হাট থেকে দরদাম করে কাজের লোক বেছে নেয়া যায়। সে কারণে কাজের লোকের দরকার হলেই এখানে চলে আসেন জমির উদ্দিন।
এই শ্রমজীবীদের একটি সংগঠন আছে। ষাটোর্ধ্ব মো. আকবর আলী সে সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন এখন। তিনি জানালেন, বৃষ্টি হলে শ্রমিক কমে যায়। নইলে দেড় শ পর্যন্ত মানুষ উপস্থিত হয় প্রতিদিন। কাজের ধরন অনুসারে প্রতিদিনের মজুরি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। সঙ্গে দুপুরের খাবার। মো. আকবর আলী জানান, বৃষ্টি বাদলের দিনে এই অসহায় মানুষগুলোর বসার কোনো জায়গা নেই। বৃষ্টি হলেই ভিজতে হয়। তিস্তাবাজার মোড়ে তিনি এই শ্রমীকদের বসার জন্য একি জায়গার আবেদন করেছেন সংশ্লিষ্টদের কাছে।