মোঃ মামুনুর রশিদ (মিঠু), লালমনিরহাটঃ জমি জমার বিরোধ কে কেন্দ্র করে গভীর রাতে নিজের শিশু পুত্র সন্তানকে হত্যা করে কৌশলে আপন ভাইদের ফাঁসায় লালমনিরহাট জেলার আদিতমারি উপজেলার বড় কমলাবাড়ি গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের পুত্র রুহুল আমিন (৫৬)। সেই ঘটনায় রুহুল আমিন আপন ভাই, ভাবী ও ভাতিজাকে ফাঁসাতে দায়ের করেন হত্যা মামলা। নিজের করা হত্যা মামলায় নিজেই ফেঁসে গেলেন রুহুল আমিন। ক্রিমিনাল ইনভেস্টিকেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডির) তদন্তে ৬ বছর পর বেরিয়ে এসেছে আসল রহস্য।
বৃহস্পতিবার বিকালে সিআইডির জেলা কার্যালয়ে এমনটিই জানিয়েছেন সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ আতাউর রহমান।
জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি রুহুল আমিনের কনিষ্ঠ পুত্র ইয়াসিন আরাফাত সন্ধ্যার পর পার্শ্ববর্তী দোকানে গুল কিনতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। এজাহারে তিনি জানিয়েছে তার কনিষ্ট পুত্র ইয়াসিন আরাফাতকে অনেক খোঁজাখুজির পরও পাননি তারা। পরদিন সকালে কান্নাকাটি ও চিল্লাচিল্লির শব্দ পেয়ে রুহুল আমিন ছুটে গিয়ে দেখতে পান তার পুত্র ইয়াসিন আরাফাতের লাশ ছেড়া চট দিয়ে ঢাকা অবস্থায় তার আপন ছোটো ভাই আবু তাহেরের গোয়াল ঘরের পিছনে মাটিতে পড়ে আছে। এরপরেই রুহুল আমিন তার শিশু পুত্রকে শ্বাসরোধে হত্যার অভিযোগ এনে ভাই ,ভাবী ও ভাতিজাকে আসামী করে আদিতমারি থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর থেকেই রুহুল আমিন তার বড় ছেলে সোহেল রানাসহ সপরিবারে আত্মগোপন করে থাকেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তারা কোনো প্রকার সহযোগীতা করেননি । এমনকি মামলার তদন্তে পুলিশ তাদের বাড়িতে গেলেও কাউকে পাননি। এরপর থানা পুলিশ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পরই রুহুল আমিন এলাকায় আসেন এবং মামলা সংক্রান্তে না রাজি করে আবারও নিরুদ্দেশ হয়ে যান।
এরপরেই আদালতের নির্দেশে এই হত্যা মামলার তদন্তে নামে সিআইডি। সিআইডির তদন্তে বেড়িয়ে আসে থলের বিড়াল। হত্যা মামলার বাদী রুহুল আমিনের পিতা আব্দুর রাজ্জাকের দুই স্ত্রী । রুহুল আমিন আব্দুর রাজ্জাকের প্রথম স্ত্রী জুলেখা বেগমের ছেলে। তার পিতা আব্দুর রাজ্জাকের ১২ একরের বেশি জমি ছিলো ওই এলাকায়। ২৫-৩০ বছর পূর্বে আব্দুর রাজ্জাক তার প্রথম স্ত্রীর সকল সন্তানকেই জমি ভাগ করে দেন এবং একটি করে বাড়ি করে দেন। তার প্রথম স্ত্রীর ছেলে রুহুল আমিন ছিলো মাদকাশক্ত। রুহুল আমিনের শ্যালকরা ওই এলাকার লাঠিয়াল প্রকৃতির হওয়ায় তাকে কেউ কোনো কথা বলার সাহস পেতো না। রুহুল আমিনের কোনো পেশাই ছিলো না। জমি বিক্রি করাই ছিলো তার নেশা। পিতার নিকট থেকে পাওয়া সকল জমি ও তার থাকার বাড়ি বিক্রি করে দেউলিয়া হয়ে যান রুহুল আমিন। এরপরে তিনি আরও জমি চাইতে থাকেন পিতা আব্দুর রাজ্জাকের কাছে। রুহুল আমিনের পিতা জমি দিতে না চাওয়ায় তার বড় ছেলে সোহেল রানা তার দাদা-দাদীকে মারধর করে। বৃদ্ধ বয়সে সেবা যত্ন করায় অন্য সন্তানদের কিছু জমি লিখে দেন আব্দুর রাজ্জাক। এই বিষয় নিয়ে ভাইদের উপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত ছিলো রুহুল আমিন। তিনি আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছিলেন ভাইদের ফাঁসানোর। বিভিন্ন সময়ে রুহুল আমিন জনসম্মুখে বলছিলেন তার ছয়টি বাতির মধ্যে একটি বাতিকে নিভিয়ে অর্থাৎ ছয় ছেলের মধ্যে এক ছেলেকে মেরে ভাইদের নামে মামলা করবে।
এর মাঝে ঘটনার দিন ২০১৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি রুহুল আমিনের পিতা আব্দুর রাজ্জাক বার্ধক্য জনিত কারনে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রুহুল আমিন তার বড় ছেলে সোহেল রানা(৩৩) ও তার ঘনিষ্ট বন্ধু রজব আলী (৫৫) কে সাথে নিয়ে ছেলে ইয়াসিন আরাফাতকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধার পর থেকে রুহুল আমিন তার কনিষ্ট পুত্র ইয়াসিন আরাফাতকে নিয়ে স্থানীয় কুমরিরহাট বাজারে চা-সিঙ্গারা খান। এরপরেই রাত সাড়ে আটটায় ছেলে ইয়াসিন আরাফাতকে নিয়ে বাসার দিকে রওনা হন যা বাজারের অনেকেই দেখেছেন। ওইদিন রাতেই রুহুল আমিন,ছোট ছেলে ইয়াসিন আরাফাত,বড় ছেলে সোহেল রানা ও রজব আলীকে তার পিতা আব্দুর রাজ্জাকের গম খেতের দিকে অনেকেই যেতে দেখেন। রুহুল আমিনের ভাই আবু তাহেরের বাড়ির পশ্চিম পাশে তার পিতা আব্দুর রাজ্জাকের গম খেতের আইলে শিশুপুত্র ইয়াসিন আরাফাতকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে পাষন্ড পিতা রুহুল আমিন। শিশু পুত্র ইয়াসিন আরাফাতকে হত্যার পর তিনজন মিলে লাশটি এনে আবু তাহেরের গোয়াল ঘরের পিছনে রেখে দেয় এবং গোয়ালের পাশে থাকা চটের ছালা দিয়ে লাশটি ঢেকে রাখেন। ওই রাতেই রুহুল আমিন তার ঘনিষ্ট বন্ধু রজব আলীকে নিয়ে তার ঘরে নেশা করেছেন এবং প্রায়ই তারা নেশা করতেন। পরদিন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভাই,ভাতিজা ও ভাবীর নামে হত্যা মামলা দায়ের করেন রুহুল আমিন। এরপরেই রুহুল আমিন তার বড় ছেলে সোহেল রানাসহ সপরিবারে আত্মগোপনে যান এবং তার ঘনিষ্ট বন্ধু রজব আলী তার পরিবার নিয়ে আত্মগোপনে যান। রুহুল আমিন প্রায় এক বছর আত্মগোপনে থাকার পর থানা পুলিশ চুড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করার পরেই জনসম্মুখে আসেন । তবে সোহেল রানা ও রজব আলী আত্মগোপনেই ছিলেন।
সিআইডি মামলার তদন্তকালীন সময়ে সোর্সের দেওয়া তথ্য ও ডিজিটাল টেকনোলজির সাহায্যে গত ২০ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর বাজার থেকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোহেল রানাকে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদে তার ছোটো ভাই ইয়াসিন আরাফাতকে তার বাবা রুহুল আমিন ও রজব আলী হত্যা করেছে বলে জানান। সোর্স ও সোহেল রানার তথ্যমতে গত ২১ ফেব্রুয়ারি নারায়নগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানাধীন মাসদাইর এলাকার ব্যপারী রোড থেকে রজব আলীকে আটক করে সিআইডি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রজব আলী জানান ইয়াসিন আরাফাতকে রুহুল আমিন ও সোহেল রানা হত্যা করেছে। এরপরেই গত ২২ ফেব্রুয়ারি আদিতমারি উপজেলার বড় কমলাবাড়ী এলাকা থেকে রুহুল আমিনকে আটক করা হয়। এরপরেই রুহুল আমিন,রজব আলী ও সোহেল রানা ইয়াসিন আরাফাতকে হত্যা করার কথা স্বীকার করে এবং কিভাবে হত্যা করা হয়েছে তা ঘটনাস্থলে সরেজমিনে গিয়ে বর্ণনা দেন রজব আলী।
ছয় বছর পর চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকান্ডের আসল রহস্য উৎঘাটন করতে পারায় প্রশংসিত হয়েছেন সিআইডি লালমনিরহাট । গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সিআইডি লালমনিরহাট জেলার এডিশনাল বিশেষ পুলিশ সুপারের দ্বায়িত্ব পান মোঃ আতাউর রহমান। তিনি যোগদানের পর থেকে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকান্ডের রহস্য উৎঘাটনসহ আরও ৬টি দীর্ঘদিনের পুরাতন মামলার রহস্য উৎঘাটন ও সকল মামলায় মোট ত্রিশ জন আসামীকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেন