স্টাফ রিপোর্টার।। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত এক বছর থেকে দেশের চাকরির বাজারের পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে পাল্টে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা না হওয়ার কারণে কর্মী ছাঁটাই করছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাটাই না করলেও নতুন নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। এর মাঝে নানান বাঁধা বিপত্তি এড়িয়ে ৪১তম বিসিএস নেওয়া হলেও সরকারি বাকি নিয়োগ পরীক্ষাগুলো বন্ধ রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা অবস্থার মুখে পড়েছেন দেশের সদ্য পাশ করা বেকার জনগোষ্ঠী। সদ্য পাশ করা এইসব কর্মহীন গ্র্যাজুয়েটদের সাথে, করোনার কারণে চাকরি হারিয়ে নতুন করে বেকার হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। যার ফলে চাকরীর বাজারে বাড়ছে প্রতিযোগিতার হার। সদ্য পাশ করা গ্র্যাজুয়েটরা ভুগছে হতাশায়। কারণ তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় লড়ছে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন করোনায় চাকরি হারা প্রার্থীরা।
এইদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংকটে বিশ্বে প্রতি ছয়জনের একজন বেকার হয়েছে। আর বাংলাদেশের প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছে (২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ)। ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই এই বেকারত্ব বাড়ছে বলে জানান তারা।
এছাড়াও মহামারিতে তারা তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে বেকার, সেই সঙ্গে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণও ব্যহত হচ্ছে তাদের। এতে তাদের চাকরিতে প্রবেশ ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় ব্যঘাত ঘটছে।
জানা গেছে, করোনাকালে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত চাকরিপ্রার্থীরা চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছেন। চাকরিতে প্রবেশের বয়স কমপক্ষে ৩২ বা ৩৫ বছর করার দাবি তাদের। এ নিয়ে আন্দোলনও করেছেন। কিন্তু তাদের কথায় এখনো কেউ সায় দেয়নি। সরকারের কোনো দায়িত্বশীল এখনো বিষয়টি নিয়ে কথাও বলেননি, এমনটাই বলছেন তারা।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বেকার রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য পাস করা শিক্ষার্থী কামরুজ্জামান রুবেল। সমাজকর্ম বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন ২০১৯ সালে। তিনি বলেন, শিক্ষাজীবন শেষ করে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা চালালেও এখনো সুযোগ হয়নি। পাশ করে বের হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই শুরু হয় করোনা পরিস্থিতি। যার ফলে নতুন কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এখনো আমার ১৫টি আবেদন করা আছে।
তিনি বলেন, ‘এগুলোর পরিক্ষা কখন হবে তার ও কোন নিশ্চয়তা নেই। বাসায় বসে প্রস্তুতি নিচ্ছি জানি না কখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে আবার পরিক্ষা দিতে পারবো। বেকার জীবন খুবই কষ্টের, প্রতিটা মূহুর্ত দুশ্চিন্তায় ভুগী।’ তার মতো শিক্ষিত বেকারদের কথা চিন্তা করে সরকারের পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান বাড়ানো উচিত বলে তিনি মনে করেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা আরেক শিক্ষার্থী রাইসুল ইসলাম । তিনি জানান, কয়েক মাস আগেও বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তিনি। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর পরই চাকরিটি ছেড়ে দিতে হয়েছে তাকে। তবে বর্তমানে চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি।
এইদিকে, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ধরে দেশের চাকরীর নিয়োগ পরিক্ষাগুলো বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় যেন মহাসংকটে পড়েছেন পাঁচ লাখেরও বেশি চাকরিপ্রত্যাশী বেকার; যারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। একদিকে চাকরি পাচ্ছেন না, অন্যদিকে টিউশনি কিংবা পার্টটাইম জবের আয় বন্ধ সবমিলিয়ে উভয়সংকটে পড়েছেন এসব গ্র্যাজুয়েটরা।
জানা যায়, করোনার কারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের নিয়োগ বন্ধ। চলতি কিংবা আগামী সেপ্টেম্বরে ৪৩ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি হওয়ার কথা এবং তার আগে প্রাইমারী শিক্ষক সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরিক্ষা হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার কারণে তা সংশয় তৈরি হয়েছে।
একইভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে বেশ কিছু নিয়োগ পরীক্ষার প্রিলি ও লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও মৌখিক পরীক্ষা হয়নি। আবার কোনো নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও প্রকাশিত হচ্ছে না চূড়ান্ত ফল। এ অবস্থায় করোনা সংকট বেকারদের কাছে মহাসংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আরেকজন চাকরি প্রত্যাশী আফসানা সোমা, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পড়াশোনা শেষ করেছেন ২০১৯ সালে। গত কয়েকবছর ধরেই তিনি সরকারি চাকরির চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, আমি সরকারি চাকরির জন্যই গত দুবছর ধরে চেষ্টা করছি। এ বছর শুধু মাত্র ৪১তম বিসিএসের পরীক্ষা হয়েছে। ব্যাংকসহ বেশ কিছু পরীক্ষার আবেদন করেছি। কিন্তু করোনার কারণে সব আটকে গেল।
তিনি আরও জানান, প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ-তরুণী বাংলাদেশের চাকরির বাজারে যোগদান করে। এদের বড় একটি সংখ্যা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এমনিতেই দেশে বেকারত্বের হার অনেক। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে নতুন পুরাতন মিলে সেই সংকট আরো বেড়েছে।
এদিকে, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ দেওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে কাজ করেন ছয় কোটি আট লাখ নারী-পুরুষ। আর দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বেকার ২৩ লাখ ৭৭ হাজার এবং অশিক্ষিত বেকার তিন লাখ।
বেকারদের মধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষিত; যারা উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। উচ্চশিক্ষা পর্বের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা শেষ করা বেকারের সংখ্যা চার লাখ পাঁচ হাজার। আর সম্ভাবনাময় কিন্তু সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের সুযোগ পান না এরকম ব্যক্তি (লেবার আন্ডার ইউটিলাইজেশন), যাদের ছদ্ম-বেকার বর্ণনা করা হয়, এরকম মানুষ রয়েছেন প্রায় ৬৬ লাখ।
এরা চাহিদা মাফিক কাজ না পেয়ে টিউশনি, রাইড শেয়ারিং, বিক্রয় কর্মী ইত্যাদি খণ্ডকালীন কাজ করেন। বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ৪.২ শতাংশ হলেও যুব বেকারত্বের হার ১১.৬ শতাংশ। করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের জুন নাগাদ সেটি কয়েকগুণে বেড়ে গেছে।
আইএলও-র সংজ্ঞা অনুযায়ী, সপ্তাহে একদিন বা এক ঘণ্টা কাজের সুযোগ না পেলে ওই ব্যক্তিকে বেকার হিসাবে ধরা হয়। সে হিসাবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সংখ্যা বাস্তবে অনেক বেশি।
অন্যদিকে চাকরিপ্রত্যাশীরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হচ্ছে না। আবার যেসব পরীক্ষা আধাসম্পন্ন হয়েছে, সেগুলোর চূড়ান্ত ফলও প্রকাশিত হয়নি। এতে করে দীর্ঘায়িত হচ্ছে তাদের প্রত্যাশা। তাদের ভাষ্য, একদিকে নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নেই, অন্যদিকে যেসব বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোও থমকে গেছে। এমন অবস্থায় কী করা যায় দিশা পাচ্ছেন না চাকরিপ্রত্যাশীরা।
তারা বলছেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের নির্ধারিত সীমা অনুযায়ী ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে কেউ আর সরকারি চাকরির নিয়োগে আবেদন করতে পারে না। করোনায় সব নিয়োগ স্থগিত এবং নতুন করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত না হওয়ায় বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি উঠেছে। যদিও এ বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত সাড়া মিলছে না।
এছাড়াও করোনাভাইরাসের কারণে তৈরি হওয়া সংকটে ব্যাংকিং, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান খরচ কমাতে কর্মী ছাঁটাই করছে। আর বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই নতুন কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে।
চাকরি খুঁজতে গিয়ে বেশ কিছু সমস্যার মুখে পড়ছেন বলে উল্লেখ করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থী ছাত্র সালেহ আহমেদ। তিনি বলেন, ২০১৮ স্নাতকোত্তর শেষ করেছি। এরপর থেকেই একাধিক সরকারি চাকরিতে আবেদন করেছি, বেসরকারি চাকরির চেষ্টাও করেছি। আশা করছিলাম, এই বছর একটা ভালো চাকরি হয়ে যাবে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে আমার সেই স্বপ্নটি ও থমকে গেছে।
তিনি বলেন, ‘এখন তো মহামারির কারণে সবকিছুই আটকে আছে। চারিদিকে কোনো চাকরি নেই, কোন পরিক্ষা নেই, যুবক সমাজ হাহাকার করছে, শোনার কেউ নেই বেকারদের আর্তনাদ!। এই মহামারি কবে শেষ হবে, কবে আবার চাকরির প্রক্রিয়া শুরু হবে জানি না। আমরা যারা বেকার আছি, চাকরির খুব প্রয়োজন, তাদের জীবনটা এই মহামারির কারণে একটা অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কোন কাজ নেই, যতদিন যাচ্ছে পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছি। পরিবারের সদস্যদের মলিন চেহারা সেই হতাশা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।’
তিনি জানান, তার বাবা মায়ের বয়স হয়েছে, এখন তার পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার কথা। কিন্তু এই মহামারির কারণে তিনি সেটা করতে পারছেন না।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বেকার যুবকদের প্রতি সরকারের আলাদা দৃষ্টি দেওয়া উচিত। তা না হলে আত্মহত্যা ছাড়া তাদের আর পথ থাকবে না। মহামারির কারণে যাদের চাকরির বয়স শেষের দিকে, তাদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা করে চাকরির আবেদনের সুযোগ দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
বিষয়টি সম্পর্কে একই রকম মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে শুধু বাংলাদেশে নয় বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই চাকরির সংকট দেখা দিয়েছে। তাই যারা গত কয়েক বছরের মধ্যে পড়াশোনা শেষ করেছেন, নতুন চাকরির চেষ্টা করছেন, তাদের উচিত হবে শুধুমাত্র কাঙ্ক্ষিত চাকরির জন্য বসে না থেকে যা পাওয়া যায়, সেটা দিয়েই কর্মজীবন শুরু করা।