প্রতিদিনের বাংলাদেশ।। শিরোনাম দেখে চক্ষু চড়কগাছ হলেও এটিই বাস্তবতা যে আপনি চাইলেই ৯৯৯ টাকার বিনিময়ে অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক বা মালিক হতে পারেন! গতকাল ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ একটি বিজ্ঞাপনে চোখ আঁটকে গেল। তাতে ৯৯৯ টাকায় পরিপূর্ণ (ডোমেইন, হোস্টিং, ডিজাইন) একটি অনলাইন সংবাদপত্র তৈরি দিবে নাম সর্বস্ব একটি ফেসবুক পেইজ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান।
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফেসবুক ব্যবহারকারীকে আগ্রহ প্রকাশ করতেও দেখলাম। এভাবেই নামে বেনামে খোলা হচ্ছে নিউজ পোর্টাল।আবার খোলা হচ্ছে টিভি নামেও অনলাইন পোর্টাল। মূলত ব্যক্তিস্বার্থ বা বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই এমন ওয়েবসাইট খোলা হয়ে থাকে। এসব সংবাদ পোর্টালের থাকে না কোন অফিস, অবকাঠামো বা নিজস্ব প্রতিনিধি। যিনি পোর্টালের মালিক, তিনিই সম্পাদক, তিনিই আবার ৬৪ জেলার প্রতিনিধি!
এসব সম্ভব হয় কেবলমাত্র কপি-পেস্ট কেরামতির মাধ্যমে। কখনো শিরোনাম পরিবর্তন করে, কখনো পরিসংখ্যানের একটু এদিক-সেদিক করে, কখনো দু-চারটি বাক্য পরিবর্তন করেই চলছে কপি-পেস্ট নিউজ কারবার। নামমাত্র এসব নিউজ পোর্টাল থেকে ছড়ানো হয় গুজব ও সরকার বিরোধী বিভিন্ন প্রচারণা। আবার কোন কোনটি থেকে ছড়ানো হয় বিরোধীদল সমূহের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন মনগড়া সংবাদ নামের মন্তব্য।
প্রায়ই নিউজ পোর্টাল সমূহ থেকে ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভিন্ন সংবাদ বানিয়ে পরিবেশন করা হয়, যার ফলে জনসাধারণ বিভ্রান্তিতে পড়ে। সম্প্রতি সময়ে দেখা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য সিনহা রাশেদ হত্যাকান্ড, করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব সৃষ্টি করা হয়েছে নাম সর্বস্ব নিউজ পোর্টাল থেকে। নেটিজেনরা খবরের সত্যতা যাচাই না করেই সামাজিক মাধ্যমসমূহে প্রচার করে এমন মুখরোচক খবরের লিংক। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে এসব গুজব। সৃষ্টি হয় ধোঁয়াশা। এসবই পুঁজি করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে নিউজ পোর্টাল সমূহ। প্রতারণাপূর্ণ খবর ছড়িয়ে ভেলকি দিয়ে ভিজিটর বাড়িয়ে এডসেন্স থেকে আয় করা থাকে তাদের মূল লক্ষ্য।
ভুঁইফোড় নিউজ পোর্টাল সমূহের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এসব কথিত সংবাদ মাধ্যমের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, থানা, বিশ্ববিদ্যালয় বা এলাকা প্রতিনিধি নিয়োগও দেওয়া হয়ে থাকে। সাংবাদিক নিয়োগ বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব কথিত সম্পাদক নামের প্রতারকরা। একই সাথে ডিজিটাল ল্যাব থেকে প্রিন্ট করে দেওয়া হচ্ছে আইডি কার্ড। আইডি কার্ড বাবদও প্রতিনিধি হতে ইচ্ছুকদের কাছ থেকে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। অনেকেই না বুঝে এমন ফাঁদে পা দিচ্ছেন।
শুধু তাই নয়, এসব পোর্টালের স্বত্তাধিকারীরা আইডি কার্ড ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন উপায়ে চাঁদাবাজির কৌশলও শিখিয়ে দেয়। প্রায়ই প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা সমূহে সাংবাদিক পরিচয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজির খবর শোনা যায়। আবার এমন নাম সর্বস্ব নিউজ পোর্টালের সাংবাদিক বা প্রতিনিধিরা মোটরসাইকেলে সাংবাদিক সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ান দাপটের সাথে। করেন নানা অপকর্ম।
সমস্যার এখানেই শেষ নয়। কথিত সাংবাদিকরা নামে বেনামে গড়ে তোলে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন। এসব সংগঠন প্রায়ই কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা ব্যক্তিস্বার্থে কিংবা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কাজ করে। কখনোবা দেখা যায়, একই ব্যক্তি ৮-১০টি অনলাইন পত্রিকার প্রতিনিধি! এতোদিন অনলাইন সংবাদপত্রের কোন নিবন্ধন প্রক্রিয়া না থাকায় বাংলাদেশে বর্তমানে কতজন সাংবাদিক রয়েছেন এবং কতগুলোইবা অনলাইন পোর্টাল রয়েছে তার সঠিক তথ্য সরকারের কাছেও নেই।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়েস স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘নিউজ রিপোর্ট’ নামে প্রথম অনলাইন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এরপর বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংবাদপত্র তাদের অনলাইন সংস্করণ চালু করে। তবে ২০০০ সালে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ‘সাউথপোর্ট রিপোর্টার’ অনলাইন সংবাদক্ষেত্রে বিপ্লব শুরু করে। প্রকৃত অর্থে পূর্ণাঙ্গ অনলাইন সংবাদপত্র এটিই বিশ্বে প্রথম। সে তুলনায় বাংলাদেশে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের যাত্রা কিছুটা পরে। তবে বাংলাদেশ খুব বেশি পিছিয়ে নেই। ২০০৫ সালের প্রথম দিকে যাত্রা শুরু করে বিডিনিউজ২৪ডটকম। ২০০৬ সালের ২২ অক্টোবর পুরোপুরি কাজ শুরু করে বিডিনিউজ২৪। বাংলাদেশে অনলাইন সংবাদ মাধ্যম ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দ্রুততম সময়ে সর্বশেষ সংবাদ পেতে অনলাইন পোর্টালের বিকল্প নেই। তবে একথাও সত্য যে, এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে কিছু অসাধু ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। এমনকি বিভিন্ন উপজেলার বা এলাকার নামেও এখন নিউজ পোর্টাল খোলা হচ্ছে অহরহ। এতে একদিকে যেমন সুবিধা আছে, অন্যদিকে অপকর্ম ঘটার ঝুঁকিও কম থাকেনা। জাতীয় পত্রিকাসমূহে স্থানীয় পর্যায়ের খবর তেমন গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয় না বলে স্থানীয় অনলাইন পোর্টালগুলো এলাকাভিত্তিক খবরগুলো ছেপে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার দরুণ প্রতিপক্ষকে হয়রানি বা সম্মানহানি করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কুরূচিশীল সংবাদও প্রকাশ করা হয় এসব পোর্টাল থেকে। আবার অনেক অনলাইন পোর্টাল আছে যেসবের মালিক বা কথিত সম্পাদক অবস্থান করে বিদেশে। সেখান থেকেই তিনি কপি-পেস্ট করে কিংবা দেশের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মনগড়া বানোয়াট গল্প লিখে প্রকাশ করেন। এতে দেশের মানুষ যেমন বিভ্রান্ত হয়, তেমনি সরকার হয় বিব্রত। বিগত দিনেও দেখা গেছে, ২০১৩ সালে যুদ্ধপরাধের দায়ে জামায়াতের বিভিন্ন নেতার রায়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে গুজব ছড়ানো হয়েছে। নামে বেনামে অনলাইন পোর্টালসমূহ নিয়ন্ত্রণ করা হতো বিদেশে বসেই। সেই ধারাবাহিকতা এখনও বিদ্যমান রয়েছে। এ বিষয়ে সরকার অবিলম্বে দৃষ্টিপাত না করলে কিছুদিন পরে সবাই নিজেদের মিডিয়া-কর্মী হিসেবে পরিচয় দেবে।
সাম্প্রতিক সময়ে যত্রতত্র নিউজ পোর্টালের বদৌলতে অপসাংবাদিকতার পালে হাওয়া দিয়েছে অনলাইন টেলিভিশন। ওয়েবসাইট বানিয়ে তাতে নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগও চলছে জোরেসোরে। সত্য, অসত্য, মনগড়া বিভিন্ন খবরের সংমিশ্রণে চলছে সংবাদ পরিবেশন। এসব অবস্থা দেখভালের অভাবে পুরো দেশ যেন পরিণত হয়েছে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিক তৈরির উচ্চ উৎপাদনশীল কারখানা!
অনলাইন সংবাদ-মাধ্যমের নিবন্ধনের পাশাপাশি নীতিমালা করে অবিলম্বে ভুঁইফোড় সংবাদ মাধ্যমগুলোকে বন্ধ করার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। তবে সেই সাথে এটিও খেয়াল রাখতে হবে, নীতিমালার ফাঁদে পড়ে যেন সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা না হয়। সর্বোপরি সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে কলুষিত করার যেকোন পথ রোধ করতে হবে। কেউ যেন এটি ব্যবহার করে হীনস্বার্থ উদ্ধার না করতে পারে সেদিকে যেমন লক্ষ্য রাখতে হবে, তেমনি নীতিমালার কুঠারের আঘাতে যেন সংবাদমাধ্যম বা অবাধ ও সুষ্ঠু সাংবাদিকতার স্বাধীনতা বিঘ্নিত না হয় সেটিরও নিশ্চিত সরকারকেই করতে হবে।