মুহাম্মদ রাসেল উদ্দিন, কুড়িগ্রাম।। প্রত্যেক মা চায় তার সন্তানেরা বেঁচে থাকুক, ভালো থাকুক। মানুষ যতই কষ্টে থাকুক না কেন কখনও নিজের সন্তানের ওপর আঁচ পড়তে দেয় না। তবে এর ব্যতিক্রম ঘটনা দেখা গেল কুড়িগ্রামে। অভাবের তাড়নায় নিজের দুই কন্যা সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছেন খোদ মা’ই।
ঘটনাটি ঘটেছে, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ী ইউনিয়নের শিমুলতলা গ্রামে। এ এলাকার ফকির মোহাম্মদ গুচ্ছ গ্রামে বসবাস করেন শারীরিক প্রতিবন্ধী মর্জিনা বেগম (৩৫)। মানসিক ভারসাম্যহীন স্বামী ও ৭জন সন্তানকে নিয়ে থাকেন তিনি। প্রতিনিয়ত টানাপোড়েনে চলে তার সংসার। দু’বেলা খাবার যোগাতে হিমশিম খেতে হয় মর্জিনা বেগমকে। বাপের বাড়ি ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে তাদের। মর্জিনার ৭জন সন্তানের মধ্যে রয়েছে ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ে। অভাবের কারণে কোনো সন্তানকেই এখনও স্কুলে ভর্তি করতে পারেনি দম্পতিটি। এমনকি অপুষ্টিতে ভুগে এক সন্তান মারাও গেছে। জীবিত থাকা সকল সন্তানই অপুষ্টিতে ভুগছে বলে জানা গেছে। সন্তানদের ভরণ-পোষণ দিতে বেগ পোহাতে হয় মর্জিনা বেগমকে। ছোট সন্তানদের বিভিন্ন জায়গায় কাজে পাঠালেও ফিরে এসেছে তারা। অবশেষে নিজের দুই কন্যা সন্তানকে বিক্রি করে দিতে পিছু পা হননি তিনি। আড়াই বছরের মধ্যে সন্তানদের বিক্রি করলেও মর্জিনার অভাবের কপাল এখনো খোলোনি।
সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, প্রায় ১৮ বছর আগে বিয়ে হয় খলিল মন্ডল ও মর্জিনা বেগমের। ভিটেমাটি না থাকায় আশ্রয় হয় উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ফকির মোহাম্মদ গুচ্ছগ্রামের একটি খুপড়ি ঘরে। স্ত্রী, ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কোনোরকমে গাদাগাদি করে থাকতেন তারা। আয়রোজগার না থাকায় অভাবের সংসারে এতগুলো সন্তানের মুখে আহার জোটানো খলিল মন্ডলের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। কোনোদিন একবেলা আবার কোনোদিন না খেয়েই স্ত্রী সন্তান নিয়ে দিন কাটে তার। প্রথম সন্তান কলিমা খাতুন (১২) মাসিক ২ হাজার টাকা বেতনে রংপুরের একটি বাসায় ঝিয়ের কাজ করছিলেন। বয়স কম হওয়ায় কাজ করতে না পারায় বাড়িতে ফিরে আসে। দ্বিতীয় সন্তান কলিমউদ্দিন জন্মের ৩ মাসের মাথায় পুষ্টিহীনতায় মারা যায়। তৃতীয় সন্তান মিজানুর (৯), চতুর্থ সন্তান ইছানুর (৪) ও চতুর্থ সন্তান খুশি খাতুন (২) বাবা মার সাথেই থাকেন।
এদিকে অভাবের তাড়নায় ৩ মাস বয়সী একটি কন্যাসন্তানকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন বাবা-মা। এর আগেও প্রায় ১৬ মাস পুর্বে ২ দিন বয়সী একটি শিশুকন্যাকে বিক্রি করেন এই দম্পতি। বিক্রি করা ওই কন্যা সন্তানরা দম্পতিটির পঞ্চম ও ষষ্ঠ সন্তান। বর্তমানে ওই দুজনের বয়স যথাক্রমে দুই মাস ও দুই বছর। জন্মের পরেই তাদেরকে বিক্রি করে মর্জিনা দম্পতি। তাদের বিক্রি করে মোট ২৩ হাজার টাকা পেয়েছিল তারা। তাদেরকে কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ও খলিলগঞ্জ এলাকায় বিক্রি করা হয়।
এলাকাবাসী জিয়াউর রহমান বলেন, ‘খলিলের জমি জমা নাই, সরকারের দেয়া গুচ্ছ গ্রামে থাকে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কাজ করবার পায় না। আশপাশের লোকজন যা দেয় তা-ই খায়। মাঝে মধ্যে চেয়ারম্যান-মেম্বার কিছু দেয়। এ ছাড়া খলিলের শ্বশুর মাসে কিছু ধান চাউল দিয়ে সহযোগিতা করে। বাচ্চাগো ভরণপোষণ করবের না পাইরা দুডা বাচ্চাক বেঁচে খাইছে।’
এ বিষয়ে উলিপুর উপজেলার চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন মন্টু সরকার বলেন, ‘আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের খলিল দুটো কন্যা সন্তানকে বিক্রি করেছে। এটা দুঃখজনক ব্যাপার। ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী গৃহহীন ও অভাবী মানুষের জন্য কাজ করছে। ওই ইউনিয়নের মেম্বার-চেয়ারম্যানদের উচিত ছিল তাদের পাশে দাঁড়ানোর। তারা পাশে না থাকলে আমাকে জানাতো আমি দ্রুত ব্যবস্থা নিতাম।’
উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা নুর-এ-জান্নাত রুমি বলেন, ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। যেভাবে পারি পরিবারটিকে সহযোগিতা করা হবে। জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম বলেন, ‘সরেজমিন পরিদর্শন করে এ বিষয়ে মন্তব্য করব।